লোকজাগরণের নায়ক

ফকির লালন সাঁই
ফকির লালন সাঁই

উনিশ শতকে বাঙালি সমাজে রেনেসাঁ এসেছিল কি না, তার স্বরূপ কেমন ছিল, প্রতীচ্যের সঙ্গে তার মিলইবা কতটুকু, নাকি তা ছিল খণ্ডিত বা অসম্পূর্ণ—এসব নিয়ে এ যাবৎ তর্কের আসর কম জমেনি! কিন্তু তাতে এসব প্রশ্নের সুরাহা বা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত বেরিয়ে এসেছে, এমন কথা বলা চলে না। তবে এ কথা কবুল না করে উপায় নেই যে সীমাবদ্ধতা-অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও উনিশ শতকের বাংলায়, স্পষ্ট করে বললে নগরকেন্দ্রিক বাংলায়, আরও নির্দিষ্ট করে বললে কলকাতা মহানগরীকে কেন্দ্র করে শিক্ষিত–বিত্তবান-কুলীন হিন্দুসমাজে একটি জাগরণ এসেছিল—এই নাগরিক জাগরণের হাওয়া ধীরে ধীরে কিছু পরিমাণে মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। নানা সংগত-বিবেচনায় রামমোহন রায়কে এই জাগরণের প্রেরণা-পুরুষ বলা হয়ে থাকে। তবে এই জাগরণের প্রধান যে দুটি অপূর্ণতা বা খামতির কথা মনে হতে বাধ্য তা হলো এই নবজাগরণের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের কোনো যোগ ছিল না, এর দায় কোন পক্ষের, সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তারপর গ্রামীণ বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠী, হিন্দু ও মুসলমান, তারাও অনুপস্থিত ছিল। এই উপেক্ষিত ও মর্যাদাহীন পল্লিবাসীর জীবনে ও সমাজে নাগরিক-রেনেসাঁর বাণী এসে কখনো পৌঁছায়নি। অথচ এই পীড়িত-অবমানিত জীবনে এমন একজনের প্রয়োজন ছিল, যিনি সামাজিক সাম্যের কথা বলবেন, নিম্নবর্গের মানুষকে পরম মমতায় আশ্রয় দেবেন, শাস্ত্রাচারমুক্ত মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হবেন, জাতপাত আর সম্প্রদায়-বিরোধের গোড়া দেবেন কেটে। অবশেষে তিনি, ফকির লালন সাঁই এলেন সামাজিক অঙ্গীকার ও মানবিক সত্যের সুসমাচার নিয়ে।

দুজন এলেন প্রায় একই সঙ্গে, একজন ১৭৭২-এ ও অপরজন ১৭৭৪-এ—মাত্র দুই বছরের ফারাক। রামমোহনের সঙ্গে লালনের বয়সের তেমন অসাম্য না থাকলেও বংশকৌলীন্য-শিক্ষা-অর্থবিত্ত-আভিজাত্য-সামাজিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে তাঁদের পার্থক্য ছিল আসমান-জমিন। পূর্বাশ্রমের ঘরোয়া বা সামাজিক জীবনের কথায় জানা যায়, লালন ছিলেন গ্রামের মানুষ—কুলগৌরব বঞ্চিত, হতদরিদ্র, নিরক্ষর। নিস্তরঙ্গ গ্রামের আর দশটা অতি সাধারণ গৃহস্থের মতোই বিবর্ণ ছিল তাঁর জীবন। এই লালনই জ্বলে উঠলেন একদিন বাউলের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে। মরমি সাধনার সূত্রে আর সামাজিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে তিনি এলেন। তাঁর গানে ও কথায় আঁধারের মুলুকে ফুটল এক নতুন আলোর রোশনাই, জাতপাতের বেড়া ভেঙে এক হলো ‘ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-চামার-মুচি’, সমাজশিক্ষক গান ধরলেন সত্য-সুপথে চলার, শোনা গেল মানবিক চেতনা আর ইহজাগতিকতার বন্দনা তাঁর কণ্ঠে, জেগে উঠল বিশাল বাংলার তমসাপীড়িত গ্রামীণ জনপদ, নতুন জাগরণ এল গ্রামে-গ্রামান্তরে। সেই জাগৃতির মহানায়ক ফকির লালন সাঁই। তবে রামমোহনের কীর্তি-কর্মের কথা পাঁচ মুখে প্রচার পেলেও উচ্চবর্গের ভদ্রজনের উপেক্ষা-অবহেলায় লালন চাপা পড়লেন। কে তাঁর কথা বলবে? পেশাদার ইতিহাসবিদেরা এ বিষয়ে নীরব হয়ে রইলেন। একবার শুধু অমলেন্দু দে কথাটি তুলেছিলেন আর অন্নদাশঙ্কর রায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন: ‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব।’

লালন জন্মেছিলেন ২৪৪ বছর আগে সংস্কারশাসিত বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে। ১১৬ বছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই দীর্ঘজীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। এই পথ ধরেই লালন সাঁই গ্রামীণ জীবনকে করেছেন চলিষ্ণু, পৌঁছে দিয়েছেন জাগরণের বারতা, আলোকিত করে তুলেছেন গ্রামীণ বাংলাকে। কত দূর প্রসারিত লালনের সেই আলোকিত বাংলা? তার জবাব মেলে মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরী পত্রিকার ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ (৩১ অক্টোবর ১৮৯০) নামে এক রচনায়: ‘লালন ফকীরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকী নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন, পূর্ব্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্য্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকীরের শিষ্য; শুনিতে পাই ইঁহার শিষ্য দশ হাজারের উপর।’

এই বিবরণ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, উনিশ শতকজুড়ে তাঁর জীবৎকালে বঙ্গ দেশে লালন ফকিরের পরিচিতি ও প্রভাব বলয় কত দূর বিস্তৃত ছিল, তাঁর জাগরণের বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল কত দূর দূর অঞ্চলে।

লালন সারা জীবন মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন, মানবতাবাদী দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, ঘুণেধরা সমাজটাকে বদলাতে চেয়েছিলেন, জাত-ধর্মকে দূরে সরিয়ে মানুষকে মানবিকবোধে বিকশিত করার ব্রত নিয়েছিলেন। সামান্য মরমি ফকিরের এসব উল্টো ধারার কর্মকাণ্ড বরদাশত করবেন কেন সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ! তাই তিনি দুশমন হয়েছিলেন তাঁদের। পাষণ্ড, ব্রাত্য, ন্যাড়া, বেশরা, জারজ—এই সব গালমন্দ, আরোপিত কলঙ্ক আর নিন্দা তাঁকে শুনতে-সইতে হয়।

মধ্যযুগের সহজিয়া কবি রূপকের ছলে উচ্চারণ করেছিলেন: ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার জন্যে লালন সেই রূপকের আড়াল তুলে দিয়ে সরাসরি বললেন: ‘অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই/ দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/ জন্ম নিতে মানবে।’ পুনর্জন্মে বিশ্বাস ছিল না লালনের, তাই একবারের জন্যে নশ্বর এই পৃথিবীতে আসার সুযোগকে, সুকৃতিতে সার্থক করে তোলার পক্ষে তাঁর ছিল একান্ত আকুতি: ‘কত ভাগ্যের ফলে না জানি/ মন রে পেয়েছ এই মানবতরণী/ বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়/ যেন ভারা না ডোবে।’ ইহজাগতিকতার হাতছানিতে লালন সাড়া না দিয়ে পারেননি: ‘এমন মানব জনম আর কি হবে/ মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।’ পরলোকে স্বর্গপ্রাপ্তির চাইতে দুনিয়ার ‘নগদ পাওনা’র প্রতিই তাঁর বেশি ঝোঁক ছিল—তাঁর গানে সেই কথাটিই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।

মানুষই ছিল লালনের মনোভূমির কেন্দ্রে। তাই মানবজীবন, মানবগুরু, মানবভজনার কথা বারবার উঠে এসেছে তাঁর গানে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘ভবে মানবগুরু নিষ্ঠা যার/ সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার’, ‘মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/ সে কি অন্য তত্ত্ব মানে’। লালনের এসব পদ সাধনার প্রয়োজনে বাঁধা হলেও তা মূলত মানব বন্দনারই গান। ‘মানুষ অবিশ্বাসে পাই নে রে সে মানুষনিধি’—এই পদটি মানুষের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার স্মারক।

বাউলের জাত-ধর্মের কোনো দায় নেই, তাই সেই পথেরই অনুসারী হয়েছিলেন লালন। এই সাধক নিজের চোখেই তো দেখেছেন, জাত-ধর্ম আর হিন্দু-মুসলমানের ভেদ-বিভেদের ফল কী ভয়াবহ! জাত-ধর্মের সুতো কেটে যৌবনের প্রথম প্রহরেই ঘর ছাড়তে হয়েছিল। তারপর তো ভাসতে ভাসতে খুঁজে পেলেন তাঁর ‘জীবনেরও জীবন সাঁই’ গুরুকে, দীক্ষা নিলেন সিরাজ সাঁইয়ের কাছে। বাউল হলেন। ধর্ম আর জাতের দাবিদাওয়া রইল না। অনেকের কৌতূহল জাগল, মানুষটি হিন্দু না মুসলমান? এঁরা লালনকে জেরবার করে তুলল তাঁর জাত-পরিচয় জানার জন্য। লালন এড়িয়েও পার পান না, জবাব দিতেই হলো শেষে: ‘সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।’ এর পরেও অতৃপ্ত জাত-সন্ধানীদের জানাতে হলো জাতপাতের অসারতার কথা। যুক্তি দিয়ে বোঝালেন: ‘বিবিদের নাই মুসলমানি/ পৈতা নাই যার সেও তো বাওনী/ বোঝ রে ভাই দিব্যজ্ঞানী/ লালন তেমনি জাত একখান।’ মধ্যযুগের ভারতের সন্ত-সাধকেরাও তুচ্ছ করেছেন জাত–ধর্মকে—কী কবির, রামদাস, কী পল্টু, রজ্জব, তুলসী দাস, কী দাদু—সবার মুখেই ওই একই কথা। চেতনা ও বিশ্বাসে লালন তো এঁদেরই উত্তরসূরি।

লালনের মনে ভাব এলে হামেশাই তাঁর গানের ‘পুনা মাছের ঝাঁক’ আসত। একতারায় আলতো আঙুল বুলিয়ে সুর তুলতেন গলায়। জন্ম নিত নানা রঙের নতুন নতুন ভাবের গান। তখন গানে মগ্ন সৌম্য-শান্ত এক মরমি সাধকের অনন্য ছবি আঁকা হয়ে যেত শিষ্য-শাবকদের চোখে। সেই সাধকই একদিন বিচলিত হয়ে উঠলেন, মনের মধ্যে ঝড় উঠল। তাঁর প্রাণের দোসর কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথকে বাঁচাতে হবে জমিদারের লাঠিয়ালের হাত থেকে। কাঙাল তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জমিদারের প্রজা পীড়নের খবর ছেপে এঁদের রোষে পড়েছেন। একতারার বদলে হাতে উঠল বাঁশের লাঠি। ছেঁউড়িয়া থেকে শিষ্য-শাবক নিয়ে লালন ছুটলেন কুমারখালীতে। হটিয়ে দিলেন জমিদারের পাইক-বরকন্দাজকে। প্রাণরক্ষা হলো প্রজাদরদি হরিনাথের। বাউলেরা যে সমাজবিচ্ছিন্ন নন, নির্জন সাধনাতেই যে শুধু তাঁদের জীবন কাটে না, এর প্রমাণ তো লালন হাতে-কলমে দিয়ে গেছেন। তাঁর কণ্ঠ বেজে উঠেছে প্রতিবাদে-বেদনায়: ‘রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি/ চোরেরও শিরোমণি/ নালিশ জানাব কার কাছ’—এ কি শুধুই রূপক, নিছকই তত্ত্বকথা, এখানে কি বাস্তবের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রকাশ একেবারেই ঘটেনি?

লালন জাত মানেননি, শাস্ত্র মানেননি, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আস্থা ছিল না। ঐশী কেতাব সম্পর্কে তাই তিনি বলতে পারেন: ‘এক এক দেশে এক এক বাণী/ পাঠান কি সাঁই গুণমণি/ এসব মানুষের রচনা জানি/ লালন ফকির কয়।’ কী ভয়ংকর কথা! কী দুঃসাহস! আর এই বক্তব্য পেশ করেছিলেন তিনি এক অজ্ঞ-অজ্ঞান-ধর্মান্ধ সমাজে বাস করে!

পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক—এসব বিষয়কেও লালন মোটেই আমলে নেননি। পাপ-পুণ্যের ধারণাকে তিনি ‘দেশাচার’ বলে গণ্য করেছেন: ‘পাপ-পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই/ এই দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পুণ্য তাই।’ মুসলমানের ‘ভেস্ত’ (বেহেস্ত) বা হিন্দুর ‘স্বর্গ’-লালন কোথাও যেতে চাননি, এ দুই-ই তাঁর কাছে ‘ফাটক সমান’ মনে হয়েছে। এই হাজতখানার বাসিন্দা হতে ‘কার–বা তা ভালো লাগে’!

লালন ছিলেন কালের অগ্রগামী পুরুষ। কিন্তু কাল বিরোধী ছিল। সমাজ-মন তৈরি ছিল না তাঁর কথা শোনা কিংবা তার তাৎপর্য বোঝার জন্য। তাই তাঁকে অনেক আঘাত সইতে হয়েছে। মনের মধ্যে কখনো বেদনা, কখনো হতাশা জেগেছে; তাই হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে গান রচনা করেছেন: ‘এ দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথা যাই না জানি/ পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা জনম গেল সেচতে পানি।’ কিন্তু মানবগুরু লালন তো পরাভব মানতে পারেন না, হতাশার কাছে আত্মসংবরণ তো তাঁর ধর্ম হতে পারে না! যাঁর তরঙ্গমুখর নদী হওয়ার বাসনা ছিল, দুকূল ভাসানো স্রোতস্বিনী হওয়ার কথা ছিল, তিনি কিনা হয়ে রইলেন ‘আন্ধেলা পুকুর’–এর বদ্ধ ‘কূপজল’! কিন্তু লালন তো মানুষকে দিশা দিতে চান, তাই সুসময়ের জন্য আশা জাগিয়ে রাখেন: ‘কবে হবে সজল বরষা, রেখেছি মন সেই ভরসা।’ একদিন বর্ষা নামবে, নব জলধারায় সিক্ত হবে এই রুক্ষ মাটি, সবুজে ভরে যাবে ফসলের মাঠ, সত্য হয়ে উঠবে লালনের স্বপ্ন।

সাধনা ও সংগ্রাম—এই দুই চেতনায় বিভক্ত লালনের একদিকে মনের মানুষের সন্ধানে শুরু হয় নিরন্তর যাত্রা, পাশাপাশি পথের কাঁটা সামাজিক বাধাকে পেরিয়ে যাওয়ার সাহসী লড়াই। এইভাবে লালন হয়ে ওঠেন একই সঙ্গে মরমি ও দ্রোহী, সমাজশিক্ষক ও সংস্কারক, অধ্যাত্ম সাধনার জ্ঞানগুরু ও মানবমুক্তির দিশারি, শুভ্র জীবনচেতনার প্রতীক ও লোকায়ত বাঙালির অনশ্বর বিবেক।