বিপন্ন যাত্রা, বিষণ্ন পুতুল, বিলুপ্ত সার্কাস

মুমূর্ষু যাত্রাশিল্পকে রক্ষা করতে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে মাঝেমধ্যে যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হয়
মুমূর্ষু যাত্রাশিল্পকে রক্ষা করতে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে মাঝেমধ্যে যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হয়

বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যমগুলো এখন গভীর অস্তিত্বসংকটে। বহু প্রাচীনকাল থেকে এসব মাধ্যম গ্রামীণ জনসাধারণের চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি লোকজীবনের সৃজন ও মননচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখন তা বিলীয়মান।

লোকসংস্কৃতির এই মাধ্যমগুলোর অন্যতম হলো যাত্রাপালা, পুতুলনাট্য বা পুতুলনাচ ও সার্কাস। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আয়োজনে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, প্রশিক্ষণ না থাকা এবং আরও নানান কারণে খুব জনপ্রিয় এই সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোর নিয়মিত কার্যক্রম প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্য প্রয়োজনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাম ও আঙ্গিক পরিবর্তন করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এতে এগুলোর মূল আঙ্গিকে বিকৃতি ঘটছে।


যাত্রাপালা নাম বদলে হচ্ছে লোকনাট্য

যাত্রাশিল্পের এখন ঘোর দুর্দিন। সারা দেশে যাত্রাপালার অনুমোদন অঘোষিতভাবে বন্ধ। যাত্রাপালা আয়োজনে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু যাত্রার কথা শুনলেই প্রশাসন আর অনুমোদন দিচ্ছে না। আক্ষেপ করে বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে প্রথম আলোকে বললেন, ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। দেশে যেখানে ৩০০-এর বেশি যাত্রা দল ছিল, এখন ৩০টি দলও সংগঠিত হচ্ছে না। প্রায় দুই বছর ধরে যাত্রাপালা বন্ধ।

সরকার শিল্প–সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহ দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও মাঠপর্যায়ের অবস্থা তার বিপরীত। কখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কখনো জঙ্গি হামলা এমন নানা ওজর-আপত্তি তুলে যাত্রার অনুমোদন দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।

দেশে যাত্রা দলগুলোর একটি জোট আছে, যার নাম যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ। এটির সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদের কাছে এখনকার ভগ্নদশার একটি ছবি পাওয়া গেল। যাত্রা দলগুলোকে প্রতিবছর শিল্পকলা একাডেমির কাছ থেকে নিবন্ধন নবায়ন করতে হয়। এবার একশটি দল নিবন্ধন নবায়ন করেছে। এই নিবন্ধনই ‘দলের লাইসেন্স’ হিসেবে গণ্য। কিন্তু নাম নিবন্ধন করে লাভ কী, পালা তো আর মঞ্চায়ন করা হয় না, তাই দলও গঠন করা হয় না। বাংলায় আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সাত মাস যাত্রার ভরা মৌসুম। এ বছর কোনো যাত্রাপালা হয়নি। শুধু সিলেট অঞ্চলের চা–বাগানগুলোতে চা–শ্রমিকদের আয়োজনে কয়েকটি পালা হয়েছে। গত বছরও ছিল একই অবস্থা।

যাত্রাশিল্পের এই নেতারা জানান, ১৯৭৫ সালের পর থেকেই যাত্রাপালা আয়োজনের ওপর বিধিনিষেধ আসতে থাকে। মাঝের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল ব্যতিক্রম। এই সময় অবস্থা ছিল সবচেয়ে ভালো। তারপর থেকে আবার বাধানিষেধ বাড়তে থাকে। তাদের বক্তব্য, ‘প্রশাসন এখন যাত্রার নামই শুনতে চায় না।’

শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবছর যাত্রা দলের নাম নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেক দলের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে নেয়। কিন্তু তারাও যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে বিশেষ কিছুই করে না। স্বাধীনতার পর থেকে সাকল্যে পাঁচবার জাতীয় পর্যায়ে যাত্রা উৎসবের আয়োজন করেছিল শিল্পকলা একাডেমি। প্রথম জাতীয় যাত্রা উৎসব হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, আর শেষবার হয়েছে ১৯৯৫ সালে। এ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমি ঢাকায় বাছাই করা সাতটি দল নিয়ে সপ্তাহব্যাপী যাত্রা উৎসব করেছিল তিনবার। ২০০৬ ও ২০০৮ সালে, তারপর সর্বশেষ হয়েছে ২০১০ সালে। এরপর থেকে যাত্রা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির আর উৎসাহ চোখে পড়ে না। অথচ মুমূর্ষু যাত্রা দলগুলোর কাছ থেকে ফিবছর টাকা আদায় জারি আছে।

যাত্রাশিল্পের সঙ্গে বহু লোকের জীবিকাও জড়িত। প্রতিটি দলে শিল্পী, কলাকুশলী মিলিয়ে জনাচল্লিশেক লোক থাকে। এ হিসাবে তিন শতাধিক যাত্রা দল অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার লোকের জীবিকার সংস্থান। পালা মঞ্চস্থ না হওয়ায় এসব মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেই চলে গেছেন অন্য পেশায়। অনেক দক্ষ অভিনেতা–অভিনেত্রী, গায়ক বাদক, পালাকার চলে গেছেন দল ছেড়ে। ফলে ক্রমেই রুগ্‌ণ, ক্ষয়িষ্ণু, নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী যাত্রার জৌলুশ।

দীর্ঘদিন ধরে যাত্রা, সার্কাস এসব নিয়ে মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান ও গবেষণা করছেন লোকগবেষক বাংলা একাডেমির সহপরিচালক সাইমন জাকারিয়া। তিনি জানালেন, ঐতিহ্যবাহী যাত্রা দলগুলো এখন অস্তিত্বসংকটে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকার চা–বাগান ছাড়া অন্য কোথাও নিয়মিত যাত্রাপালা আর হয় না। চা–বাগানে এই যাত্রা হয় চা–শ্রমিকদের জন্য। এখানে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক পালাই প্রধানত মঞ্চস্থ হয়, সেখানে সবার প্রবেশের সুযোগ থাকে না। নির্দিষ্ট কিছু দলই সেখানে পালা মঞ্চস্থ করে।

যাত্রা দলগুলো তাদের অস্তিত্বের সংকট কাটাতে এখন এক বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছে। যাত্রাপালার কথা উল্লেখ করলে যেহেতু প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া যায় না, তাই যাত্রা দলগুলো নাম বদলে দলের নাম রেখেছে ‘লোকনাট্যদল’। যেমন নরসিংদী জেলার কথাই ধরা যাক। সেখানে পুরোনো ও জনপ্রিয় অনেকগুলো যাত্রা দল ছিল। এখন মাত্র আটটি দল আছে। তারা নাম পাল্টে ফেলেছে। লোকনাথ অপেরা হয়েছে ‘লোকনাথ নাট্য সংস্থা’। অনেকে আবার পরিচালক বা দলপ্রধানের নামেই দলের নাম রেখেছেন। বর্তমানে যাত্রামঞ্চের শীর্ষ অভিনেত্রী ফরিদা পারভিন নিজের নামে তাঁর দলের নাম রেখেছেন ‘ফরিদা নাট্য সংস্থা’। আরেকটি দলের নাম ‘মেঘনা নাট্য সংস্থা’।

যাত্রা দলগুলোর যে কেবল নাম পরিবর্তন হচ্ছে তা-ই নয়, তাদের মঞ্চায়নের রীতিও বদলে যাচ্ছে। প্রশাসনের কাছে তারা লোকজ নাটক মঞ্চায়নের অনুমোদনের জন্য আবেদন করে থাকে। ফলে যাত্রার মতো প্যান্ডেল করে আর পালা পরিবেশন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। টিকিট বিক্রিরও কোনো ব্যবস্থা নেই। সাইমন জাকারিয়া জানিয়েছেন, খোলা মঞ্চে এসব লোকনাট্য মঞ্চস্থ করা হয়। স্থানীয় কোনো মহল বিশেষ কোনো উপলক্ষে তাদের এলাকায় নির্দিষ্ট কয়েক দিন লোকনাট্য মঞ্চায়নের জন্য প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়। এরপর তারা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। একটি দরদাম করে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকায় দলগুলো তাদের পুরোনো পালাগুলোই একটু এদিক-ওদিক করে মঞ্চায়ন করে। যাত্রার অভিনয় বলতে গেলে এখন এভাবেই চলছে।

গ্রামবাংলায় যাত্রাপালা নাম পাল্টে এখন হয়ে যাচ্ছে লোকনাট্য
গ্রামবাংলায় যাত্রাপালা নাম পাল্টে এখন হয়ে যাচ্ছে লোকনাট্য

বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে নিজেও একজন খ্যাতিমান অভিনেতা। যাত্রার এ চেহারা বদল তিনি মানতে পারেন না। বললেন, যাত্রাশিল্পের একটি বিশেষ আঙ্গিক আছে, রীতি আছে। সেই আঙ্গিকটিই যদি না রক্ষা করা যায়, তবে এভাবে লোকনাট্য করে লাভ কী?

বিবর্ণ বিষণ্ন পুতুল

দেশে পুতুলনাচের অবস্থাও বিপন্ন। এসব পুতুল জীবজগতের প্রজাতি হলে এত দিনে আইইউসিএনের লাল ডেটা বইতে নাম উঠে যেত। এককালে দেশজোড়া খ্যাতি ছিল যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচের, এখন সেই খ্যাতি পুরোনো দিনের ধুলোয় ঢাকা মলিন স্মৃতি। পুতুলগুলো বিষণ্ন, তারা মুখ গুঁজে বাক্সবন্দী হয়ে থাকে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশে ‘রয়েলবীণা পুতুলনাচ’ আর ‘বাণীবীণা পুতুলনাচ’ নামে দুটি দল কোনোমতে টিকে আছে। এই দুটি দলেরই কর্ণধারেরা একই পরিবারের চাচা ও ভাতিজা। রয়েলবীণা পুতুলনাচের আদি মালিক ও শিল্পী ছিলেন ধন মিয়া। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে ছেলে শামিম মিয়া এখন দলটি চালান। এই পরিবার থেকেই আলাদা দল ‘বাণীবীণা’ করেছেন শামিমের ভাতিজা হেলু মিয়া। চাচা–ভাতিজার কাছ থেকে জানা গেল, পুতুলনাচের পসার আর আগের মতো নেই। কোনো উৎসব পরবে বা মেলার আয়োতন হেল সেখানে কালেভদ্রে তাদের ডাক পড়ে। পেশাগতভাবে কেউ আর শুধুই পুতুলনাচের সঙ্গে যুক্ত নেই। দলের সদস্যরা সারা বছর বিভিন্ন কাজ করেন। কোথাও কখনো নাচের বায়না পেলে দলের লোকদের ডাক দিয়ে তাঁরা প্রদর্শনী করে আসেন। সে কারণে নিয়মিত চর্চাও নেই, নতুন ধরনের পুতুল তৈরিতেও আগ্রহ নেই।

পুতুলনাচ নিয়ে গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রশীদ হারুন। তিনি এ বিষয়ে একটি বড় আকারের গ্রন্থও রচনা করেছেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য নামে, যেটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। তিনি জানালেন, ঢাকাসহ সারা দেশে এখন ১২ থেকে ১৫টি দল সক্রিয় আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের বিপিন পালকেই এ অঞ্চলে পুতুলনাচের প্রবর্তনকারী বলে মনে করা হয়। পরে গিরীশ আচার্য, তারু মিয়া প্রমুখ শিল্পীর গড়া দলের মাধ্যমেই পুতুলনাচ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘পুতুলনাচ’ বলা হলেও আগে এসব পুতুল তৈরি করা হতো পৌরাণিক কাহিনির চরিত্র অনুসারে এবং অভিনয় হতো রাধা–কৃষ্ণের লীলা, সীতাহরণ, বেহুলার ভাসান এসব। হিন্দু–মুসলিম সব ধর্মের লোকে বহুশ্রুত এসব লোককাহিনির পুতুলনাট্যাভিনয় দেখে আনন্দ উপভোগ করতেন। ভারতভাগের পরে পুতুলনাচের অধিকাংশ হিন্দু দলপতিই ভারতে চলে যান। তাঁদের রেখে যাওয়া পুতুলগুলো নিয়েই দল চালানোর চেষ্ট করেন স্থানীয় মুসলিম শিল্পীরা। ধন মিয়া ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তবে তিনি নতুন করে পালা তৈরি করতে পারেননি। পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ায় পৌরাণিক কাহিনিগুলোর অভিনয়ও ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়। অভিনয়ের বদলে পুতুলের নাচানাচিই প্রধান হয়ে ওঠে। পুতুলনাট্য ক্রমান্বয়ে পুতুলনাচে পর্যবসিত হয়। বহুবার দেখা পুরোনো পুতুলের একই ধরনের নাচ দেখতে দেখতে দর্শকেরাও এর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। রশীদ হারুন জানান, ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের শিল্পীরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন চিত্রনাট্য তৈরি করতে পারেননি, পুতুল সঞ্চালনায়ও নতুনত্ব আনতে পারেননি। তাঁদের বাচনিক ত্রুটি, উপস্থাপনায় অনেক সময় সুরুচির অনুপস্থিতি, অতি নিম্নমানের মঞ্চসজ্জা এসব মিলিয়েই ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

পুতুলনাট্যের শক্তি ও সম্ভাবনা বিপুল। আধুনিকভাবে একে নগররুচির উপযোগী করে উপস্থাপনের চেষ্টা শুরু করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি ধারাবাহিকভাবে বিষয়ভিত্তিক পুতলনাট্য করেছেন। অধ্যাপক রশীদ হারুন জানালেন, তাঁরা নতুন আঙ্গিকে পুতুলনাট্য চর্চার বিস্তৃতি ঘটাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাঁরা গড়ে তুলেছেন, এর নির্বাহী পরিচালকও তিনি। তাঁরা জোর দিচ্ছেন পুতুলের অভিনয়ের দিকে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে আধুনিক পুতুল তৈরির ওপর কর্মশালা, নতুন নতুন গল্প নিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি ও আন্তর্জাতিক পুতুলনাট্য উৎসবে অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে দেশের এই ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প মাধ্যমটিকে তুলে ধরার কাজ করে যাচ্ছেন।

অধুনা ‘জলপুতুল’ নামের একটি পুতুলনাট্য দলও হয়েছে, যারা বিষয়ভিত্তিক পুতুলনাট্য করে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে। তবে এসবই চলেছে সীমিত পরিসরে। মাধ্যমটিকে যথার্থভাবে বিস্তৃত করতে দরকার সহায়তা, পৃষ্ঠপোষকতা। এ দিকটায় ঘাটতি রয়েছে ব্যাপক।

সার্কাস আর হয় না

যাত্রা ও পুতুলনাচ নিয়মিত না হলেও দেশের কোথাও না কোথাও তবু মাঝেমধ্যে হচ্ছে। সে তুলনায় সার্কাস প্রায় বন্ধ। যাত্রার মতোই সার্কাসেও একটি প্রধান সমস্যা প্রশাসনিক অনুমোদন। এই অনুমোদন পাওয়া অতি দুরূহ। সার্কাসের দল টিকিয়ে রাখাও খুব ব্যয়বহুল। যাত্রা বা পুতুলনাচের মতো চট করেই দল গঠন করা যায় না। সার্কাসের বিভিন্ন কসরতের জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন, তাদের নিয়মিত অনুশীলন জরুরি। সে কারণে দল ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেলে ফের সার্কাসে ফিরে আসা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ দলে থেকে জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। তাই অনেকে দল ছেড়ে গেছেন। অধিকাংশ সার্কাসের দল এভাবেই বিলুপ্ত হয়েছে। এখন নামেমাত্র তিন–চারটি দল টিকে আছে।

সার্কাস নিয়ে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন সাইমন জাকারিয়া। তিনি জানালেন, আমাদের দেশে সার্কাসের দলগুলো হয় মূলত পরিবারকেন্দ্রিক। একজন মূল মালিক থাকেন। তাঁর পরিবার, জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের নিয়েই দল গড়ে ওঠে। একটি দলে ১০০–১৫০ জন লোক থাকে। অনেক বড় তাঁবু ফেলতে হয়, অনেক সরঞ্জাম আনতে হয়। বিশালাকার গ্যালারিও নিজেদেরই বসাতে হয়। অনেক লোক, অনেক শ্রমের প্রয়োজন। আর সার্কাসের উপযোগী বড় ও স্থায়ী মাঠের দরকার হয়। আর ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্থানে সার্কাসের আয়োজন করতে হলে একটি স্থানে অন্তত ১৫ দিন প্রদর্শনী না করলে লোকসান হয়। ঢাকায় এখন আর তেমন মাঠ নেই। মফস্বলের জেলাগুলোতেও ইদানীং লম্বা সময় ধরে তেমন কোনো মেলার আয়োজন হয় না। আবার শুধু লোকবল হলেই চলে না, সার্কাসের জন্য হাতি, বাঘসহ নানা রকম প্রাণীও প্রয়োজন। এসব প্রাণী রাখার অনুমোদন পাওয়া যায় না। এসব কারণেই সার্কাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

পুতুলনাচের প্রধান সমস্যা সৃজনশীল গল্পের অভাব
পুতুলনাচের প্রধান সমস্যা সৃজনশীল গল্পের অভাব

বাংলাদেশের সার্কাস দলগুলোর মধ্যে বিখ্যাত দল ছিল বরিশালের লক্ষণ দাসের রয়েল বেঙ্গল সার্কাস। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। পরে তাঁর ছেলেরা সোনার বাংলা সার্কাস নাম দিয়ে দলটি চালু করেছিলেন। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এই দলটি। এ ছাড়া, সেভেন স্টার সার্কাস, দি রওশন সার্কাস, দি ক্যাপিটাল সার্কাস, দি লায়ন সার্কাস—এই দলগুলোও একসময় সারা দেশে ঘুরে ঘুরে সার্কাস করেছে। সাইমন জাকারিয়া জানালেন, এখন ফরিদপুরে কবি জসীমউদ্‌দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যে লোকমেলা হয়, সেখানেই কেবল নিয়মিত সার্কাস হয়। এ ছাড়া নিয়মিত আর কোথাও সার্কাস হয় না। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলে কিছু কিছু বড় আকারের মেলা হয়, কোনো মেলা এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে চলে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব মেলায় জড়িত থাকলে তাঁরা সার্কাসের অনুমোদন আনতে পারেন। এই অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে কোনো কোনো মেলায় মাঝেমধ্যে সার্কাসের বিশাল রঙিন তাঁবু মাথা তুলে দাঁড়ায়।

(নিবন্ধটি তৈরিতে তথ্যসহায়তা দিয়েছেন প্রথম আলোর ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি শাহাদত হোসেন ও নরসিংদী প্রতিনিধি প্রণব দেবনাথ