'আমায় ক্ষমা করবেন'

পিচঢালা রাস্তার দুই পাশে কত গাছ দাঁড়িয়ে! সারি সারি আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল আর ঝাউ গাছ। আছে ছোট ছোট বুনো বট আর ভাটি গাছের বাহারি পাতা ফুল। এমন সবুজ ঘন রাস্তার দুধারে সকাল-সন্ধ্যা সাদা মেঘের মতো বিপুল জলরাশি আছড়ে পড়ছে। রৌদ্রছায়া ঘেরা এমন মায়াবী সড়ক ধরে সাইকেল চালিয়ে রোজ সকালে তিনি আসতেন স্কুলে। দিনের কোনো একভাগে শিক্ষার্থীদের শোনাতেন তাঁর প্রিয় বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনের গল্প। রসিকতা করে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘নিউটন বলে গেছেন, ইট মারলে পাটকেল খেতেই হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে।’

যাঁর কথা বলছি, তাঁর নাম জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল। আমার প্রিয় জগদীশ স্যার। গায়ের রং তাঁর ফরসা। গোলাকার মুখ। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। প্রখর রসবোধ ছিল তাঁর। তাঁর চোখে জল দেখেছিলাম এক দিন। কী কান্না, সে কী হাহাকার! আক্ষেপ করে তিনি বলছিলেন, ‘আর কোনো দিন সবুজ ঘাসের বুকে বসে রোদ খেতে পারব না।’

শীতের সকাল। মেঘ ঠেলে সূর্য উঁকি মারছে। আমরা কজন বিজ্ঞান ভবনের বেঞ্চে বসে আছি। এ ভবনে আমাদের বিজ্ঞানের ক্লাস হতো। জগদীশ স্যার ঢুকলেন। স্কুলের উত্তর দিকে বিশাল বিল। উত্তরের হিমেল হাওয়া হু হু করে জানালা দিয়ে ঢুকছে। আমার গায়ে চাদর, তবু কনকনে শীতে লোম দাঁড়িয়ে গেছে। দেখি, জগদীশ স্যার রীতিমতো কাঁপছেন। জগদীশ স্যার বললেন, ‘চলো আমরা মাঠে যাই। রোদ খাওয়া হবে, শীত লাগবে কম, পড়াশোনা ভালো হবে।’

ব্যস, স্যারের কথা শেষ আমরা হাজির সবুজ মাঠে। স্যার এসে বললেন, ‘কেমন লাগছে তোমাদের?’ আমরা বললাম, ‘স্যার আমরা এখন থেকে মাঠেই ক্লাস করব।’ স্যার বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে ঝালমুড়ি আনবে কে?’ আমরা বললাম, ‘স্যার, ঝালমুড়ি!’ স্যার বললেন, ‘হ্যাঁ, ঝালমুড়ি। শীতের সকালে ঝাঁজওয়ালা সরিষার তেল আর লাল টুক টুক মরিচ দিয়ে মাখা ঝালমুড়ি খেতে বড় মজা।’

সেই থেকে শীতের সকালের নরম রোদ খেতে নীল আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের ওপর বসে জগদীশ স্যারের ক্লাস করতাম। স্কুল মাঠের সামনে সারি সারি বাঁশ গাছ। জোরে বাতাস বইলে বাঁশঝাড় থেকে পাখির মতো কিচিরমিচির শব্দ আসত। সাদা রঙের একতলা লাইব্রেরি ভবনের সামনের ঝাউগাছের পাতার শো শো আওয়াজ ভেসে বেড়াত স্কুলপ্রাঙ্গনে।

আমার সামনে একদিন এক শিক্ষক জগদীশ স্যারের কাছে জানতে চান, ‘জগদীশ বাবু আর কত দিন বাদে অবসরে যাবেন?’ জগদীশ স্যার বললেন, ‘বেশি দিন বাকি নেই।’ এর কিছুক্ষণ পর শ্রেণিকক্ষে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। চোখ মুছতে মুছতে আমায় বললেন, ‘এ স্কুল আমায় ছেড়ে যেতে হবে। এ আমি মানতে পারছিনে। যা আমি জানি, যেটুকু বিদ্যে আমার আছে—তা তোমাদের শুনিয়ে আমার আত্মা প্রতিদিন শান্তি পেত। বিশ্বাস করো, আমি আর এই স্কুলে আসতে পারব না। তোমাদের দেখতে পাব না—এ আমি মানতে পারছি নে।’

সত্যি সত্যি সময় ঘনিয়ে এলো জগদীশ স্যারের। আমি দেখেছি জগদীশ স্যারের শেষ বিদায়ের দিন। সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ছাত্র কিংবা সহকর্মী শিক্ষক যাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, জগদীশ স্যার বলছিলেন, ‘দোষে-গুনে মানুষ, আমায় ক্ষমা করবেন।’ সবার যেমন বিদায় অনুষ্ঠান হয় জগদীশ স্যারের বেলায় তাই হলো। কত ফুলের তোড়া এলো। স্যারকে নিয়ে ভালো ভালো কথা হলো।

স্কুলের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিন শেষ বিকেলে রওনা হলেন জগদীশ স্যার। দেখলাম, জগদীশ স্যারের চোখ দুটি কী ভয়ানক লাল। চোখের নিচে পানির বিন্দুগুলো সোনালি আলোয় কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন সেই সেই পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে একাকী জগদীশ স্যার বাড়ি ফিরে গেলেন। সাঙ্গ হলো জীবনের একটি অধ্যায়। স্কুল থেকে স্যারের বাড়ির দূরত্ব ছ'মাইল। জগদীশ স্যার বলতেন, ‘মানুষ বড়ই রহস্যময়। এই জীবনে আমায় আমি চিনতে পারলাম না?’

লেখক: সাংবাদিক