সালাম স্যার শুধু শিক্ষকই নন, কোচ-গুরু-পথ প্রদর্শক

মুহাম্মদ আবদুস সালাম। ছবি: লেখক
মুহাম্মদ আবদুস সালাম। ছবি: লেখক

শিক্ষক বলতে আমরা বুঝি যিনি পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমার কাছে শিক্ষকের সংজ্ঞা ভিন্ন। আমার কাছে শিক্ষক হচ্ছেন তিনিই, যিনি আলোর পথ দেখান, সুন্দরের পথ দেখান। এ সংজ্ঞা এমনি এমনি হয়নি। জীবনে এমন একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি, যাঁর সান্নিধ্যে জীবন হয়েছে আলোকিত। আজ আপনাদের সেই মহান শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব!
আবদুস সালাম চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের একজন শিক্ষক। অন্য ৮-১০ জন শিক্ষকের মতো আমার কাছেও একজন সাধারণ মানের শিক্ষক ছিলেন। পরে ধারণাটা পাল্টে যায়।

সময়টা ২০১১ সালের জানুয়ারির কোনো একদিন। স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, যা অবশ্যই সুখকর ছিল না! গিয়েছিলাম নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে। সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস করা তরুণ তখন। খানিক ভাব নিয়ে হাফ হাতা শার্ট, জিনস প্যান্ট এবং চপ্পল পরে গেলাম ভর্তি হতে। সালাম স্যার ছিলেন শ্রেণিশিক্ষক, তিনিই ছাত্রদের ভর্তি করাচ্ছিলেন। অপেক্ষা করতে করতে যখন আমার সিরিয়াল এল, তখন স্যার আমাকে একনজর দেখলেন, বললেন ‘এই ছেলেকে আমি ভর্তি করাব না, আগামীকাল স্কুল ড্রেস পরে আসবা, এরপর বাকিটা দেখা যাবে।’
যা-ই হোক, মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। পরদিন অবশ্য ড্রেস কোড অনুযায়ী গিয়ে ঠিকঠাকমতো ভর্তি হলাম!
এরপরই মূলত স্যারকে চেনা শুরু করলাম! একেকটা ক্লাস যায়, আর স্যারের কিছু কিছু কথা মস্তিষ্কে নাড়া দেয়! স্যারের একেকটা বাক্য, একেকটা যুক্তি, একেকটা উদাহরণ নতুনভাবে ভাবাতে শুরু করে, নতুন কিছু করতে উদ্দীপনা জাগায়।

এভাবে দিন যেতে লাগলে স্যারকে ভালোবাসতে লাগলাম।

ঘটনাচক্রে একদিন স্যার কোনো একটা পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। স্যারকে বললাম, ‘স্যার এভাবে তো সেসব ছাত্র পড়ে যারা জিপিএ-৫ পায় কিংবা সে রকম কিছু আশা করে! আমার মতো ছাত্ররা এভাবে না পড়লেও হয়।’ স্যার রেগে গেলেন আমার কথা শুনে, বললেন, ‘তুমি জিপিএ-৫ পাব না কেন? তুমিও পাবা। আর শোনো, জিপিএ-৫ পাওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হও! নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো! জিপিএ-৫ এমনিতেই হবে!’

মুহাম্মদ জহির রায়হান। ছবি: লেখক
মুহাম্মদ জহির রায়হান। ছবি: লেখক

জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-২.৫ পাওয়া একটা ছেলেকে একজন শিক্ষক ৫.০ পাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছেন, করেছেন অনুপ্রাণিত! এরপর থেকে প্রতিটা ব্যাপার নিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলতাম। স্যার সব সময়ই আমার পড়ালেখার খোঁজখবর নিতেন। আর জিপিএ-২.৫ পাওয়া একটা ছেলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, সেও একজন ভালো ছাত্র হতে পারে, হয়তো কিছুটা হতে পেরেছেও!

এখন আমি দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এখনো আমি আমার সব বিষয় নিয়ে স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করি! জীবনে যখনই থমকে দাঁড়ায়, তখনই স্যারকে স্মরণ করি, স্যারের পরামর্শ নিই। স্যারের অনুপ্রেরণার মতো শক্তি আমি আর কিছুতেই পাই না।

জানি না কতটা ভালো মানুষ হতে পেরেছি, সব সময়ই চেষ্টা করি এমন কিছু করতে যাতে স্যারের কথা অনুযায়ী ‘ভালো মানুষ’ হতে পারি।

এ রকম শত শত শিক্ষার্থীর মানুষ গড়ার কারিগর আমাদের সালাম স্যার, যার অসংখ্য শিক্ষার্থী দেশ বিদেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরিতে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে আছে এবং সুনাম কুড়াচ্ছে, যাদের সবার কাছে সালাম স্যার শুধু একজন শিক্ষকই নন, একজন কোচ, একজন গুরু, একজন অভিভাবক এবং একজন পথপ্রদর্শক।

সালাম স্যার, আপনাকে অজস্র সালাম এবং শ্রদ্ধা জানাই। আরও অনেকের বুকে ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার জন্য আপনার আরও অনেক বছর বেঁচে থাকা দরকার।

লেখক: মুহাম্মদ জহির রায়হান

স্যার: মুহাম্মদ আবদুস সালাম
যোগাযোগের নম্বর: ০১৯৯১৯৫২৯৯১
ঠিকানা: কম্পিউটার ল্যাব, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মিউনিসিপ্যাল মডেল উচ্চবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম