প্রত্যেকটি মেয়ের গল্প শুনতেন তিনি!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসানা আলম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসানা আলম।

সময়টা ২০১১ সাল। অনেক স্বপ্ন নিয়ে হলি ক্রস কলেজে ভর্তি হতে এসেছি। ভর্তি পরীক্ষার দিন ভীষণ চিন্তিত ছিলাম। আর ভয় তো ছিলই। মৌখিক পরীক্ষায় যখন নির্বাচিত হয়ে গেলাম, তখন খুশির খবরটা প্রথমে আম্মুকে জানানোর জন্য ফোন দিয়েছিলাম। আর ফোন রেখে পেছনে ঘুরতেই দেখি সাদা শাড়ি পরা একজন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, আর বলছেন, ‘কেবল তো শুরু। অনেক দূর যেতে হবে মেয়ে।’

আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তখনো জানতাম না যে, তিনি হলি ক্রস কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা গোমেজ। তখন বুঝতে পারেনি যে, তাঁর দেখানো পথ ও অনুপ্রেরণা আজ পর্যন্ত আমার জীবনে এতখানি প্রভাব ফেলবে! ভর্তি হওয়ার পর সৌভাগ্যক্রমে ওনার বাংলা ক্লাস পেয়ে গেলাম। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতাম, আর ভাবতাম একজন মানুষ কীভাবে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। নিজের চারপাশকে অনেক সুন্দর করে তুলতে পারেন সিস্টার শিখা গোমেজ। তিনি খুব ভালো করে বুঝিয়েছেন যে, একজন শিক্ষকের দায়িত্ব কেবল পড়া দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একজন শিক্ষক একজন শিল্পী, যিনি তাঁর ভালোবাসা দিয়ে রাঙিয়ে তুলবেন শিক্ষার্থীদের ভুবন। শিক্ষক প্রত্যেকের গল্প শুনবেন, প্রত্যেকের আদর্শ হয়ে উঠবেন।

পরিবারকে ছেড়ে প্রথমবার একা থাকাটা মোটেই সহজ ছিল না আমার জন্য। মাঝে মাঝে টিফিন পিরিয়ডে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একদিন সিস্টার নিজে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে?’ মন খারাপ শুনে তিনি বললেন, ‘বোকা মেয়ে, তুমি তো বড় হচ্ছ। পড়াশোনা করে রেজাল্ট ভালো হলে মা বাবা কত খুশি হবেন।’শুধু আমার নয়, এভাবে প্রত্যেকটি মেয়ের গল্প তিনি শুনতেন। আর কীভাবে যেন মন ভালো করে দিতেন সবার! এরপর যখনই মন খারাপ থাকত, সিস্টারের সঙ্গে কথা বললে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করতাম।

হলি ক্রস কলেজ। ছবি: লেখিকা
হলি ক্রস কলেজ। ছবি: লেখিকা



সিস্টার সব সময় বলতেন, অন্যের জন্য কিছু করার মাঝে যে আনন্দ তা কিছুতেই পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বুঝিয়েছেন, একজন নারী কীভাবে পৃথিবীটা আরও সুন্দর করে তুলতে পারে। তাঁর থেকেই শেখা—একটি মেয়ের প্রধান দায়িত্ব হলো ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা দেওয়া এবং চারপাশকে প্রাণবন্ত করে তোলা। কলেজ ছেড়েছি অনেক দিন, কিন্তু এই কথাগুলো পুরো জীবনের পথচলার সঞ্চয় হিসেবে রাখতে চাই।

এখনো রাস্তায় সিস্টারের সঙ্গে দেখা হলে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিতে ভোলেন না তিনি। শিক্ষক দিবসে আমার এই প্রিয় শিক্ষকের প্রতি অনেক অনেক ভালোবাসা। প্রত্যাশা করি তিনি দীর্ঘজীবী হোন এবং হয়ে উঠুন অনেক মেয়ের অনুপ্রেরণার গল্প।

লেখিকা: স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়