বিদ্যুৎ স্যারের আজ বড় প্রয়োজন

সিলেট পুলিশ লাইন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যুৎ জ্যোতি চক্রবর্তী। ছবি: লেখক
সিলেট পুলিশ লাইন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদ্যুৎ জ্যোতি চক্রবর্তী। ছবি: লেখক

১৯৯৮ সালের এক কনকনে শীতের সকালে অনেক ভয় আর স্বপ্ন নিয়ে হাজির হই সিলেট পুলিশ লাইন উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ‘গ’ শাখায়। নতুন স্কুলে একগুচ্ছ অপরিচিত মানুষের ভিড়ে নতুন নতুন শিক্ষকদের হৃদয়গ্রাহী পাঠদানের ভেতর দিয়ে চলতে থাকে আমার স্কুল জীবন। ভর্তির পর থেকেই সব ছাত্রের মুখে শুধু একজন স্যারের কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল, কারণ স্যার নাকি খুব কড়া এবং রাগী! অবশেষে প্রায় দুই বছর পর অষ্টম শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়। সেই শিক্ষক হলেন শ্রী বিদ্যুৎ জ্যোতি চক্রবর্তী।

আমি প্রথম দেখায় বিস্মিত হয়ে যাই স্যারের অসম্ভব সুন্দর ব্যক্তিত্বপূর্ণ গলার স্বর শুনে। চমৎকার সাবলীল ভাষায় ক্লাসে স্যারের পাঠদান আমাকে দিন দিন স্যারের প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকে। স্যার আমাদের গণিত ক্লাস নিতেন। চিরকালই আমার গণিতভীতি ছিল। কিন্তু কেন জানি স্যার যেভাবে গণিত বিষয়টা পড়াতেন, সেটি তখন আমার কাছে কঠিন মনে হতো না।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন স্যার ক্লাসের সবাইকে বীজগণিতের সূত্র ধরতে আরম্ভ করলেন। এর আগে দুই সপ্তাহ ধরে তিনি আমাদের এ সূত্র শিখিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কেউই সেদিন সূত্রগুলো বলতে পারলাম না। স্যার খুব রাগান্বিত হলেন কিন্তু কেন জানি কিছু বললেন না। পরের দিন থেকে তিনি আবার সেই সূত্রগুলো আমাদের পড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, তিনি আশা করেন আমরা সূত্রগুলো আবার শিখে আসব এবং কোনো সমস্যা থাকলে স্যারকে জিজ্ঞাসা করব। স্যারের এই উদারতা আমাদের মুগ্ধ করল।

গণিতের বাইরেও যে বিশাল জগৎ আছে, স্যার তার নানা দিক আমাদের প্রায় সময়ই বলতেন। কিছুদিন পর আমি, সেলিম, সাইফুল, মায়নুল, জিহানসহ আরও কয়েকজন বন্ধু স্যারকে খুব অনুরোধ করে উনার বাসায় পড়তে গেলাম। সেখানে যাওয়ার মাসখানেক পর আমরা বুঝতে পারলাম স্যারকে আমাদের কিছু টিউশন ফি দেওয়া উচিত।

তায়েফ আহমদ চৌধুরী। ছবি: লেখক
তায়েফ আহমদ চৌধুরী। ছবি: লেখক



কিন্তু আমাদের ৩-৪ জনের আবার টিউশন ফি দিতে গেলে পরিবারের আর্থিক সংগতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক চিন্তাভাবনার পর আমরা অবশেষে স্যারকে সমস্যাটি খুলে বলব বলে ঠিক করলাম। আমরা যখনই স্যারকে এই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলাম, স্যার যেন কীভাবে সেটি বুঝে নিলেন। স্যার খুব ভারী স্বরে বললেন, ‘তোমাদের আমি মন দিয়ে পড়তে বলেছি, সেটি করবে। এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে ভাববে না। জীবনটা অনেক কঠিন। এখানে দরিদ্রতা একটি পরীক্ষা মাত্র। তোমরা সামনের এসএসসি পরীক্ষা ভালো করো, আমি খুব খুশি হব। এভাবেই সামনের দিনের পরীক্ষাগুলোয় ভালো মেধার স্বাক্ষর রেখে তোমরা দারিদ্র্য নামক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়ে সুখ-শান্তি-সফলতার নতুন জীবনে অবতীর্ণ হবে।’

আজকে জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও স্যারের সেই কথাগুলো ভুলিনি। আমাদের জন্য স্যারের এই অশেষ কষ্ট এবং অন্য শিক্ষকদের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় আমরা ২০০৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে সক্ষম হই। স্যার আমাদের মধ্যে পরিশ্রম, সততা, দেশপ্রেম আর চারিত্রিক উৎকর্ষ বিকাশের যে বীজ বপন করেছিলেন, তার ফল আজ আমরা ভোগ করছি। বন্ধুরা সবাই খুব ভালো আছে। বিদ্যুৎ স্যারের মতো সাহসী, নির্ভীক, রুচিতে নান্দনিক এবং চরিত্রে ইস্পাতকঠিন শিক্ষক আজকের এই দিনে খুবই প্রয়োজন। পরিশেষে নগরবাউল জেমসের ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে, ‘মানুষেরও যে আকাশের মতো হৃদয় থাকতে পারে, তাকে না দেখলে হয়তো আমার জানাই হতো না।’

বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এই দিনে সালাম তোমায় গুরু।

লেখক: চিকিৎসক