স্যারকে জিজ্ঞাসাই করা হলো না

যখন খুব ছোট ছিলাম, বাবা গল্প শোনাতেন কীভাবে লেখাপড়া করে চাচা বড় মানুষ হয়েছেন। গল্প শুনে বুকের মধ্য কম্পন অনুভব করতাম। তাই আমিও কল্পনা করতাম কবে চাচার মতো হব। কিন্তু বাবা দিনমজুর। তাই পড়াশোনা করে বড় মানুষ হওয়াটা নিজের কাছে রাতের খোয়াবের মতো মনে হতো। কিন্তু গ্রামের একজন দিলখোলা মানুষ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, তুমি অনেক বড় হবে। মনে মনে হাসতাম। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছি, এসেই দেখি সেই মানুষটা চাচাদের উঠানে। কাজল স্যার সেদিন অঙ্ক খাতা দেখিয়েছেন, আমি ১১ পেয়েছি। সেই মানুষ জানতে চাইলেন আমি কত পেয়েছি। আমি বললে তিনি শুনে হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, আমি অনেক বড় হব। সেদিন বিকেলে এক ফকির এলেন। আমার মা তাঁকে দেখালেন। তিনিও বললেন, আমি অনেক বড় হব, আর বাংলাদেশের পড়া শেষ করব।

এভাবে দিন কেটে যায়। এরপর হাইস্কুলে উঠলাম। দিলখোলা সেই মানুষটি সেই হাইস্কুলে ইংরেজি পড়াতেন। আর প্রতি বৃহস্পতিবার লাইব্রেরি থেকে আমাদের বই দিতেন। আমি তাঁর নিয়মিত বই গ্রহীতা হলাম। তিনি আমার পছন্দের বই আমাকে নিতে দিতেন না। নিজে দেখে, পছন্দ করে, আমাকে বই দিতেন। মন খারাপ করতাম। কারণ অন্য ছেলেমেয়েরা ইচ্ছেমতো বই নিতে পারত।

খুব রাগ হতো। আমার রাগ দেখে তিনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতেন, এখনো তোমার চোখ ফোটেনি। যখন ফুটবে, তখন ইচ্ছেমতো বই নেবে। তারপর তাঁর পছন্দের কত বই পড়েছি পাঁচ বছরের হাইস্কুল জীবনে। এখনো অনেক বই পড়ি। এইতো সেদিন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেছি। বাবা আজও দিনমজুর। তিনি আমাকে নিয়ে গর্ব করেন।

কিন্তু যেই দিলখোলা মানুষ আমার মাথায় হাত বুলিয়েছিলেন, আমার চোখ ফোটার কথা বলেছিলেন, প্রায় চার বছর হলো তিনি দুনিয়া ছেড়েছেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো না, স্যার আমার কি চোখ ফুটেছে? শিক্ষক দিবসে সেই দিলখোলা মানুষ, আমার ইউনুস স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

লেখক: জাহাংগীর আলম।