'স্যার কী, ভাইয়া বলে ডাক ব্যাটা'

২০১০ সালের কোনো এক কাঠফাটা রোদের দুপুরে, টিফিন পিরিয়ডের পর অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ের একটা ‘চলন্ত’ ক্লাসের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি কয়েকজন মিলে। যাওয়ার পথে দেখি লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বিশাল একটা ঘোমটা দিয়ে এক নতুন ‘বউ’ ক্লাস নিচ্ছেন! নতুন বউ বললাম, কারণ ঘরে যখন নতুন বউ আসে, সবার কাছে প্রথম প্রথম তার চেহারা যেমন অচেনা থাকে, তেমনি আমাদের কাছে এই লাল শাড়ি পরিহিতার চেহারাও বেশ অস্পষ্ট লাগছিল। পরক্ষণে বুঝলাম তিনি আমাদের এক নতুন ম্যাডাম। যাক ছেলেপেলে তখনই দুষ্টবুদ্ধি আঁটতে থাকল কীভাবে নতুন ম্যাডামকে বিরক্ত করতে পারবে। এইটে পড়ি তখন। আমরা তখনো তাঁর ক্লাস পাইনি। কয়েক দিন পর দেখি ইনি আমাদের হাউসে (হোস্টেল) ঘোরাঘুরি করছেন, হাউস মাস্টারের সঙ্গে রাউন্ডে আসছেন। পরে জানতে পারলাম, ম্যাডাম আমাদের হাউসেই থাকবেন। সে সময় যেসব নতুন শিক্ষক যোগদান করতেন তাঁদের ঢাকায় বাসস্থান না থাকলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁদের ছেলেদের হাউসে থাকার ব্যবস্থা করত। তো তখন বয়স মাত্র ১২-১৩ বছর। মা-বাবাকে ছেড়ে হোস্টেলে থাকতাম। তখন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের নিয়মকানুন ছিল অত্যধিক কড়া। বাসায় কথা বলার কোনো উপায় থাকত না। কালেভদ্রে প্যারেন্টস ডে আর মাঝে মাঝে হাউস মাস্টার-হাউস টিউটরদের থেকে বলে-কয়ে বাসায় ফোন দেওয়া যেত। তো এই নতুন ম্যাডাম আসার পর এক রাতে নাইট ক্লাস থেকে এসে তাঁর কাছে গেলাম আম্মুকে ফোন দিতে। সেদিন খুব খারাপ লাগছিল বাসার জন্য। ম্যাডাম দেখলাম খুব ভালো ব্যবহার করে বাসায় ফোন দিতে দিলেন৷ এরপর থেকে প্রায়ই তাঁর কাছে যেতাম খালি বাসায় ফোন দেওয়ার জন্য ব্যস, এভাবেই পরিচয়ের শুরু। ম্যাডাম কতটা ফ্রেন্ডলি সেটা পরের বছর স্পোর্টসের সময় রাত জেগে সবাই মিলে যখন ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’-এর জন্য প্ল্যান করেছিলাম, সে সময় বুঝেছিলাম। ম্যাডামও আমাদের সঙ্গে রাত জেগে কাজ করছিলেন, নতুন নতুন প্ল্যান বলছিলেন আর তাঁর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। এমনভাবে গল্পগুলো বলছিলেন, মনে হচ্ছিল আমরা সেভেন-এইটের বাচ্চারা সেগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

প্রায়ই আমাদের সঙ্গে ম্যাডাম আড্ডা দিতেন। কখনো আমাদের রুমে এসে, কখনো তাঁর নিজের রুমে। এরপর এক সময় তিনি চলে গেলেন হাউস ছেড়ে, আমরাও চলে গেলাম সিনিয়র হাউসে। যোগাযোগটা কমে গেল একটু একটু করে। পরে একদিন পরীক্ষার হলে উনি আমার গার্ড দিচ্ছিলেন। পরীক্ষার মাঝে বললেন, যাওয়ার আগে যেন দেখা করে যাই। পরীক্ষা শেষে তাঁর কাছে গেলে বললেন, ‘এই ফাইয়াজ শোন, দুই সপ্তাহ পর আমার বিয়ে। অনেক কাজ-টাজ করা লাগবে। রেডি হতে থাক।’ কথাটা শুনে অবাক হয়েছিলাম খুব। ক্লাসের স্টুডেন্ট থেকে কখন যে ওনার ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে গেলাম, সেটা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি। বিয়ের দিন ভাইয়াকে ‘স্যার’ বলে ডেকেছিলাম! বিয়ের আসরে বসে ম্যাডাম যেভাবে সবার সামনে বলেছিলেন, “স্যার কী, ভাইয়া বলে ডাক ব্যাটা” কথাটা সারা জীবন মনে থাকবে আমার। প্রথমবার যখন ঈদের সময় ওনার বাসায় দাওয়াত দেন ম্যাডামের মা, বোন, কাজিনদের সঙ্গে কথা বলে একবারের জন্য মনে হয়নি এনারা আমার টিচারের ফ্যামিলি মেম্বার৷ বরং নিজের খালা, খালাতো বোনদের চেয়ে একটুও কম মনে হয়নি মানুষগুলোকে। সেবার এইচএসসির সময় আম্মুকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো৷ আব্বু অনেক আগে থেকেই অসুস্থ, তাই সব দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ওপর। সেই সময় ম্যাডামও অসুস্থ। ম্যাটারনিটি লিভে। এই খবর জানার পর উনি ওই শরীরে হাসপাতালে আসার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, আমি সব একা সামলাতে পারছিলাম কি না, সেটার জন্য। এ রকম কেয়ার পেয়ে সেবারও খুব অবাক হয়েছিলাম। উনি আমার সঙ্গে যতটা ফ্রেন্ডলি, যতটা ফ্রি, সেটার পরও এটাকে আসলে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক নাকি বড় বোন-ছোট ভাইয়ের সম্পর্ক বলে, আমি জানি না। একটা মানুষ যে একই সঙ্গে শিক্ষক, অভিভাবক, বড় বোন, বন্ধু—এত কিছু হতে পারে, সেটা কেয়া ম্যাডামকে না দেখলে হয়তো জানতাম না। আমি হয়তো কোনো দিনও ম্যাডামের মতো এ রকম সাধারণের মাঝে অসাধারণ মানুষ হতে পারব না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, ওনার মতো শিক্ষককে যে জীবনে পায়নি, সে যে কতটা অভাগা, তা সে নিজেও জানে না!
সব সময় ভালো থাকবেন ম্যাম। আপনার ছেলে ‘ফাইয়াজ।’

লেখক: ফাইয়াজ