রাত তিনটায় ফোন পেয়ে ছুটে এলেন শিক্ষক

২০১৫ সাল, দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্রতীরবর্তী একটি অজপাড়া গাঁ থেকে নানা প্রতিকূলতার সাগর পারি দিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় যে কী জিনিস, সে সম্পর্কে জ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা। ভাবতাম, বিশ্ববিদ্যালয়, সে তো বিশাল ব্যাপার-স্যাপার!


ভাবতাম, এখানের শিক্ষক মহোদয়রাও অনেক বড় মানুষ, সহজেই তাঁদের সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। সংস্পর্শে যাওয়া দূরে থাক, ভাবতাম তাঁদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব? কী বলতে গিয়ে কী আবার ভুল-ভাল বলে ফেলি। এই ভয়ের কারণে কথা বলা আর হয়ে ওঠেনি ক্লাস শুরুর দুই মাস পার হওয়ার পরও।

এখানে একটু উল্লেখ করে রাখি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বেশ কয়েক দিন পর আমাদের ক্লাস শুরু হয়, তাই ভর্তি হয়েই বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু ভর্তির সব কার্যক্রম শেষ হয়নি। ক্লাস শুরু হলে বাকি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু কত দিন পর্যন্ত এই কাজ চলবে? ক্লাস কবে থেকে শুরু হবে? ওরিয়েন্টেশন ক্লাস কি বাধ্যতামূলক? এই ক্লাস না করলে কি ছাত্রত্ব চলে যাবে? এই রকম অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না। এক বড় ভাইয়ের ফোন নম্বর নিয়েছিলাম, তিনি সব বিষয় স্পষ্ট করতে পারেননি। সেই বড় ভাই এক স্যারের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন সেই স্যারকে ফোন দেওয়ার মতো দুঃসাহস আর হয়ে ওঠেনি। তাই এমন সময় এলাম, এসে দেখি আমার আসার আগেই প্রায় এক সপ্তাহ ক্লাস হয়ে গেছে।

প্রথম দিন ক্লাসে এলাম, এক স্যারের ক্লাস অসম্ভব রকম ভাল লাগল! স্যার রুটিন মাফিক নিয়মিত ক্লাস নিয়ে যাচ্ছেন। এক বছর হয়ে গেল, রেজাল্ট হলো সেই দিন একটা তথ্য জানার জন্য স্যারকে ফোন দিলাম, স্যার ফোন রিসিভ করেই বললেন, ‘হাবিবুল্লাহ কেমন আছো? কী খবর বলো?’ আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম! একটা ক্লাসে আমরা শিক্ষার্থী ১২০ প্লাস, স্যার কীভাবে আমার নাম মনে রাখলেন? নাম না হয় মনে রাখলেন কিন্তু আমার ফোন নম্বর স্যারের কাছে কীভাবে গেল?

আমি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম, চোখের কোণে দুই ফোঁটা পানি চলে এল!

আমার মতো একটা নগণ্য শিক্ষার্থীর খবর যে স্যার রাখেন, তিনি নিঃসন্দেহে শুধু একজন শিক্ষকই নন, আদর্শ শিক্ষক তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে একজন অভিভাবকও। এর প্রায় এক বছর পরের একটি ঘটনা, আমি একটা বিপদের সম্মুখীন হলাম, কিন্তু বিপদের সময় কারও কথা মনে হয়নি, মনে হলো স্যারের কথা, স্যারকে ফোন দিলাম। তখন রাত তিনটা প্রায়, সেই গভীর রাতে স্যার আমার ফোন ধরলেন এবং আমার সমস্যার কথা শুনলেন। এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। কল্পনা করা যায়! একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রাত তিনটায় ছাত্রের ফোন পেয়ে ছুটে আসেন! তিনি আসছেন।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সার্থক যে আমি তাঁর মতো একজন গুরুজন পেয়েছি। তিনি আমার চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণাকে বদলে দিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে একজন ভালো মানুষ হতে হয়। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে অসহায়, বলহীন মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হয়। তাঁর কাছে শিখেছি শিক্ষা কাকে বলে, শিক্ষার কী উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তাঁর কাছে আরও শিখেছি একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি, রাষ্ট্রের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি আমার কী দায়িত্ব ও কর্তব্য। তিনি এই জীবনটাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীর প্রেরণা।

এ পর্যন্ত আমার প্রায় ১০টি লেখা জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। এর পেছনেও সার্বিক পরামর্শ ও উৎসাহ ছিল আমার প্রিয় এই স্যারের। আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষকের আচরণ যদি এমন হতো, কতই না সুন্দর হতো!

সব শেষে বলব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কিউবার বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ আর আমি বলব, আমি সক্রেটিস-প্লেটোর মতো মহান শিক্ষকদের দেখিনি কিন্তু আমি ড. সুলতান মাহমুদের মতো স্যারকে দেখেছি।
স্যার ভালো থাকবেন, অনেক ভালো।
এই কামনা চিরন্তন।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী