কিছু ঘটনা এবং একজন শিক্ষক

ক্যাপ্টেন ডা. মোহাম্মদ শরফুদ্দিন পাটোয়ারীকে পিপস পরিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মা। ছবি: লেখক
ক্যাপ্টেন ডা. মোহাম্মদ শরফুদ্দিন পাটোয়ারীকে পিপস পরিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মা। ছবি: লেখক

স্থান: বঙ্গোপসাগরের মেঘনার মোহনায় অবস্থিত দ্বীপ, সন্দ্বীপ।

সময়: রাত ১০টা, সাল ২০০০।

‘ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা খবরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি...ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এ বছরের সেরা ছাত্র বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মিখাইল আনোয়ার।’...
- ‘আব্বু, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া কোথায়?’
- ‘আমেরিকার একটি অঙ্গরাজ্যে।’
প্রতিদিন বাবা-ছেলে রাত ১০টায় একসঙ্গে খবর শোনেন। ছেলের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় বাবাকে। স্বপ্ন দেখতে শেখান বাবা।

- ‘আব্বু, তুমি কি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে পড়ার জন্য?’
- ‘না। আমি হার্ভার্ডে যাব, আব্বু।’

সকাল ৬টা
ফজরের নামাজের পর কাস্তে-কোদাল হাতে শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে নিয়ে মাঠে যান। পুকুর পাড়ে ছোট্ট ফসলি জমি। পিতা-পুত্র সেখানে অল্প কৃষিকাজ করেন। বাবা কোদাল দিয়ে মাটি খোঁড়েন, আর ছেলে লাঠি দিয়ে মাটির চাক গুঁড়া করে। ছেলে ঘাস বাছাই করতে করতে ভাবে, এই আগাছা ঘাসের বৈজ্ঞানিক নাম কি কেউ দিয়েছে? আমি কি কিছু আবিষ্কার করতে পারব?
মরিচ ও কচুর চাষ করেন বাপ-ব্যাটা।

সকাল ৮টা
টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে ছেলে উঠে পড়ে বাবার সাইকেলের পেছনে। মাস্টার শামসুদ্দিন সাহেব সাইকেল চালান।
- ‘আব্বু, Tense কী? Gerund কী? present participle এর উদাহরণ দাও তো।’

দেখতে দেখতে বাবা-ছেলে স্কুলে চলে আসে। ছেলে চলে যায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে। বাবা সাইকেল রেখে অফিসকক্ষে টিফিন ক্যারিয়ার রাখেন। একটু পরেই তাঁকে ক্লাস নিতে যেতে হবে, ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি ক্লাস। একটু অস্বস্তি কাজ করে তাঁর মধ্যে। ক্লাসের প্রথম ছাত্র তাঁর ছেলে ক্লাসে কি ডাকবে তাঁকে?
- ‘রোল ১ - ইয়েস স্যার’

সাল ২০০১
শামসুদ্দিন সাহেবের আজ মন খারাপ। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে তাঁর ছেলেকে আজ রেখে যেতে হবে। আগামী ছয় বছর এখানেই বড় হবে সে। বড় হওয়ার সব সবক তো তিনি দিয়েই দিয়েছেন এত দিন। এবার প্রতিষ্ঠানের পালা। নূরছাপা স্যারকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। তিনি তার ছাত্রের প্রতিভা খুঁজে বের করেছেন। ক্যাডেট কলেজের কথা তিনিই বলেছেন তাঁর ছেলেকে।

ছেলে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আব্বু ক্যাডেট কলেজ কী?’
বাবার উত্তর, ‘না বাবা, ক্যাডেট কলেজ আমাদের জন্য না।’
কিন্তু নূরছাপা সাহেব নাছোড়বান্দা। তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রকে বলেন, ‘তুমি অনেক বড় হবে বাবা, অনেক বড়।’

রাতে শুয়ে ছাত্র ভাবে, কত বড় হব আমি? একসময় বাবা রাজি হলেন ক্যাডেট কলেজে ছেলেকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। প্রস্তুতিতে শামসুদ্দিন সাহেব নিজেই সাহায্য করলেন প্রচুর। স্কুলের খেলার মাঠ থেকে ধরে নিয়ে এসে ছেলেকে বসাতেন নবম/দশম শ্রেণির ছাত্রদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে একই ইংরেজি পড়িয়েছেন। তাঁর ছেলে ফার্স্ট না হলে কে হবে?

সাল ২০১৪
মাস্টার শামসুদ্দিন ও বেগম শামসুদ্দিন রওনা দিয়েছেন ঢাকার পথে। ছেলের কনভোকেশন। আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছে তাঁদের ছেলে।
‘বাবা, সব সময় গরিব রোগীদের দিকে খেয়াল রাখবে। ডাক্তারের ব্যবহারে রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়। নিজের শিকড়কে ভুলে যাবে না।’ মানুষ গড়ার এই কারিগর সব সময় তাঁর শিক্ষা দিয়েই যান।

সাল ২০১৫
স্থান: বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি
মাস্টার শামসুদ্দিন সাহেবের পরিবার আজ অনেক গর্বিত। তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা—সবাই এসেছেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে। আজ তাঁর ছেলের পিপিং সিরিমনি। তিনটি পিপস একসঙ্গে পরিয়ে দিয়েছেন তাঁরা নিজেরাই। একজন বাম কাঁধে, আর অন্যজন ডান কাঁধে। আজ থেকে তিনি ক্যাপ্টেন ডা. মোহাম্মদ শরফুদ্দিন পাটোয়ারীর বাবা।

এতক্ষণ আমার প্রিয় শিক্ষক, আমার বাবাকে নিয়েই লিখছিলাম। আমার মা-ও একজন শিক্ষক। দুজনের দেখানো পথেই আমার পথচলা।

লেখক: সেনা কর্মকর্তা