ওষুধ নীতির সুফল ওষুধশিল্পের বিকাশ

>

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির হিসাবে দেশের চাহিদার ৯৭ শতাংশ ওষুধ দেশেই তৈরি হয়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে দেশি কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ এখন ওষুধ আমেরিকা ও ইউরোপে রপ্তানি করছে। দেশের ওষুধশিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা ছিল ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির। সামরিক শাসনামলে করা ওই ওষুধ নীতির প্রধান রূপকার ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ওষুধ নীতি নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল

প্রথম আলো: আপনি একজন ভাস্কুলার সার্জন। ওষুধ নীতি তৈরির মতো বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণ কী ছিল?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ষাটের দশকে আমি বিলেতে ভাস্কুলার সার্জন হিসেবে কাজ করতাম। ওই সময় আমরা একটা খবর জেনে খুব আপসেট হয়ে পড়ি। যুক্তরাষ্ট্রের টেরামাইসিন নামের যে ওষুধ বাজারে চলত, তা তৈরি হতো পূর্ব ইউরোপের একটি সমাজতান্ত্রিক দেশে। পশুর ওষুধ এবং টেরামাইসিন একই কারখানায় তৈরি হতো।

প্রতারণার আরেকটি বিষয় চোখে পড়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। আমি তখন গ্রামে ডাক্তারি করি। দেখতাম এক দিনের চিকিৎসার জন্য যাঁরা ঢাকায় আসতেন, তাঁদের সাত দিনের উপার্জন শেষ হতো। যক্ষ্মার ওষুধ ব্রিটেনে দাম ছিল ৬ ডলার। সেই ওষুধের দাম বাংলাদেশে ৪৯ ডলার। বিচিত্রায় ওষুধ সাম্রাজ্যবাদ নামে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের ওষুধের সার্বিক পরিস্থিতি আমি শেখ সাহেবকে বুঝিয়েছিলাম। তাঁকে বলেছিলাম, দেশে ওষুধের দাম কমাতে হলে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। তিনি পূর্ব ইউরোপ থেকে ওষুধ আমদানির ব্যবস্থা করেছিলেন। ওষুধ নিয়ে কাজ করা আমার অনেকটা নেশার মতো। জিয়াউর রহমানকেও আমি ওষুধের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। এরপর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওষুধ নিয়ে আমি কী করতে চাই জানতে চেয়েছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমদ শরীফসহ অনেকেই এরশাদের সঙ্গে কাজে না জড়াতে বলেছিলেন।

প্রথম আলো: ১৯৮২ সালে দেশে ওষুধের বাজার বা পরিস্থিতি কী ছিল?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ১৯৮২ সালের দিকে ১৬ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হতো, ৮৪ শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হতো। ওষুধের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত ৮টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। বিদেশি বেশ কয়েকটি কোম্পানির এ দেশে কোনো কারখানা ছিল না। তারা অন্য কোম্পানির কারখানায় ওষুধ বানিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ড লাগিয়ে বাজারজাত করত। বাজারে তখন প্রায় ২ হাজার ৫০০ ওষুধ ছিল।

প্রথম আলো: ওষুধ নীতি তৈরির কাজটি কীভাবে শুরু করেছিলেন?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: এরশাদ সাহেবকে বলেছিলাম, একটি যথাযথ কমিটির মাধ্যমে ওষুধ নীতি প্রণয়নের কাজটি করতে হবে। ৮ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তখনকার পিজি হাসপাতালের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) পরিচালক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। খুব কম সময় নিয়ে আমরা কাজটি করেছিলাম। ওষুধ নীতি প্রণয়নের কাজে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘সিলেকশন অব অ্যাসেন্সিয়াল মেডিসিন’ প্রকাশনাটি বিশেষ কাজে লেগেছিল। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করা, ওষুধ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ওষুধ বাজার থেকে বের করে দেওয়া।

প্রথম আলো: নতুন এই ওষুধ নীতির প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: ওষুধ নীতির প্রতিক্রিয়া ছিল বহুমাত্রিক। ওষুধ নীতির সমালোচনা করে তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেন এবেল কুন ১৯৮২ সালে তাঁর সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, নতুন ওষুধ নীতির কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লোকসান হবে।

এই নীতি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে এতটাই দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল যে একদিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির রাষ্ট্রদূতেরা এক হয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। তাঁরা এরশাদকে অন্য কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন। অন্যদিকে গোয়েন্দাদের একটি অংশ সরকারকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে যে এই ওষুধ নীতির কারণে বহুজাতিক কোম্পানি চলে গেলে ভারতীয় ওষুধে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সরকারকে এটা বোঝাই যে বাংলাদেশে ওষুধের দাম কমলে ভারতের ওষুধ এই বাজারে সুবিধা করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকদের কাছে ভারতীয় ওষুধের নাম কম পরিচিত বলে ব্যবস্থাপত্রে তা লিখবেন না।

প্রথম আলো: দেশের বাজারে এই নীতি কী প্রভাব ফেলেছিল?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: জাতীয় ওষুধ নীতির ১২টি নিয়ন্ত্রণকারী পদক্ষেপের কারণে বাজার থেকে ১ হাজার ৭০০টি ওষুধ বাতিল হয়ে যায়। তখন বাজারের ৩০ শতাংশ ওষুধ ছিল নিম্নমানের। ওষুধ প্রশাসন দুই সপ্তাহের মধ্যে রেসিপি পাস করতে শুরু করল। দেশি কোম্পানিগুলো ওষুধ বানানো শুরু করল। কোনো কোনো ওষুধের দাম এক–তৃতীয়াংশ কমে গেল। ওষুধ আমদানি কমে গেল। নামহীন দেশি অনেক কোম্পানি বড় কোম্পানিতে পরিণত হলো। গ্রামগঞ্জে মানুষ অল্প দামে মানসম্পন্ন ওষুধ পেতে শুরু করল।

প্রথম আলো: এই নীতি থেকে অন্য দেশগুলো কী শিক্ষা নিয়েছে?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বিলেতের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের ওষুধ নীতি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনাও হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশ বাংলাদেশের নতুন ওষুধ নীতি ও এর প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করে। তবে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের মতো ওষুধ নীতি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আগে থেকে অনুসরণ করে আসছিল।

প্রথম আলো: ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি থেকে বাংলাদেশ কতটা সরে এসেছে?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: দেশি কোম্পানিগুলো বড় হয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ল। তারা বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে দিয়ে নীতিতে পরিবর্তন আনল। খালেদা জিয়ার সরকার বলল, ১১৭টি ওষুধ ছাড়া অন্য সব ওষুধের দাম ঠিক করবে ওষুধ কোম্পানি। অন্যদিকে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) ওষুধের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া দোকান থেকে অনেক ওষুধ এখন কেনা যায়। এই ওষুধের সংখ্যা কমানো উচিত।

প্রথম আলো: বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কী পরিবর্তন প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: প্রথম কাজ হবে ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন। খালেদা জিয়ার সরকার যে ভুল করেছিল, তা সংশোধন করতে হবে। সব ওষুধের দাম সরকার ঠিক করবে, কোম্পানিকে ১০০–২০০ শতাংশ লাভ দিয়েও সরকার মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাদ দেওয়ার জন্য কমিটি করতে হবে। বড় ৫০টি কোম্পানিকে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির জন্য বলতে হবে, শর্ত দিতে হবে। যার নিজের কোম্পানি নেই, সে ওষুধ তৈরি করতে পারবে না। ওষুধের মোড়কের গায়ে ওষুধের জেনেরিক ও ট্রেড নাম সমান হরফে লেখা থাকতে হবে।

ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনা যায়, এমন ওষুধের সংখ্যা কমাতে হবে। প্রতিটি ওষুধের দোকানের অন্তত দুজন লোককে ওষুধ ও ওষুধ বিপণনের ওপর তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এতে দুই লাখের বেশি শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান হবে। এর ফলে ওষুধ বিক্রিতেও সুষ্ঠুতা আসবে। মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।