সুন্দর জীবনের অনুষঙ্গ

নিজেকে সুন্দর করে তোলার জন্য পারলার এখন হয়ে উঠেছে আদর্শ জায়গা। ছবি: কবির হোসেন
নিজেকে সুন্দর করে তোলার জন্য পারলার এখন হয়ে উঠেছে আদর্শ জায়গা। ছবি: কবির হোসেন

লেখা, ফটোশুট আর সারা দিন টো টো করে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা। প্রথম আলোর ফিচার বিভাগের প্রথম দিকের বছরগুলো কেটেছে এভাবেই। ফটোশুটের একটা বড় অংশ কেটে যায় পারলার, মানে সৌন্দর্যচর্চা কেন্দ্রে। এমনও হয়েছে, সকাল নয়টায় গিয়েছি, রাত আটটায় আমরা বের হয়েছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাঁটা হতো, এ মাথা থেকে ও মাথা। মেকআপ, চুল কাটা, তেল লাগানো কিংবা ভ্রু তুলতে আসা গ্রাহকদের সেবা নেওয়াটাও দেখা হয়ে যেত।

গত ১০ বছরেই পাল্টে গেছে অনেক কিছু্। ২০-৩০ বছর আগের চিত্র ছিল আরও আলাদা। পারলারে কিছুক্ষণ বসে থাকলে তার একটা আভাসও কিন্তু পাওয়া যায়। পারলারটা একসময় জমজমাট জায়গা ছিল না। ধীরে ধীরে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে দেখেছি আমরা। এখন শুধু চুল ধোয়াতেও আসেন অনেকে। কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় চট করে সেবা নিয়ে নেন। আমাদের জীবনযাপনে পারলার এখন নিয়মিতভাবে যাওয়ার জায়গা। দেশজুড়ে পারলারের সংখ্যাটাই জানিয়ে দিচ্ছে আমাদের জীবনযাপনে এর আধিপত্যের কথা।

আরাম, নিজের জন্য একটু সময়, বিলাসী সেবা, সৌন্দর্যচর্চা, সাজগোজ—সবকিছুর জন্যই পারলার হয়ে উঠছে আদর্শ জায়গা। বয়স এখানে কোনোভাবে সীমারেখা টানতে পারেনি। আগে যেখানে দুবার ভাবতেন যাওয়া উচিত হবে কি না পারলারে, সেখানে এখন তিন প্রজন্ম একসঙ্গে চলে যায়। কিশোরী বয়সটাই মূলত সরগরম করে রাখে চুল কাটার জায়গাটিকে। ফেসিয়াল, ভ্রু তোলা, চুলের পরিচর্যা, ম্যানিকিউর, পেডিকিউর ইত্যাদি সেবায় সময় দেন মা, খালা কিংবা নানি-দাদি।

আরাম, নিজের জন্য একটু সময়, বিলাসী সেবা, সৌন্দর্যচর্চা, সাজগোজ—সবকিছুর জন্যই পারলার হয়ে উঠছে আদর্শ জায়গা। বয়স এখানে কোনোভাবে সীমারেখা টানতে পারেনি। আগে যেখানে দুবার ভাবতেন যাওয়া উচিত হবে কি না পারলারে, সেখানে এখন তিন প্রজন্ম একসঙ্গে চলে যায়। ঢাকায় এখন আছে পারসোনা, ফারজানা শাকিলস মেকওভার স্যালন, কিউবেলা, হারমনি স্পা অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা বিউটি স্যালন, রেড বিউটি পারলার অ্যান্ড স্যালন, মিউনিজ ব্রাইডাল, বানথাই বারবার অ্যান্ড বিউটি স্যালন, হেয়ারোবিক্স, অরা বিউটি লাউঞ্জ, ওমেনস ওয়ার্ল্ড, বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ, মেনস কেয়ার, অ্যাডোনিস, ডিভাইন বিউটি স্যালন, লাবেল বিউটি স্যালন, নিল’স, প্রিভে স্যালন অ্যান্ড স্পা ইত্যাদি নামকরা স্যালন রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। চট্টগ্রামে আছে পারসোনা, হাবিব তাজকিরাস, আলভিরা’স, ফেয়ার টাচ, নিউ লুক, বিউটি বাফে ইত্যাদি স্যালন। বরিশালের কাঞ্চি ডিলাক্স, এভারগ্রিন, অপ্সরী, রুনি’স, মুন হারবাল জনপ্রিয়। সুকন্যা বিউটি পারলার, লিভিং স্টার, লিভিং ডল ইত্যাদি বেশ পরিচিত।

যশোরেও পারলারের বেশ দাপট। আছে হলি, টুইঙ্কেল, জেসিকা, সানন্দা, ক্ল্যাসিক, ড্রিম গার্ল ইত্যাদি বিউটি পারলার। খুলনায় আছে এক্সক্লুসিভ বিউটি পারলার, ফেইস প্লেস, চার্মিং বিউটি পারলার, দুলহান বিউটি পারলার, এশিয়ান জেন্টস পারলার, স্পা জেন্টস পারলার, শাহবাজ জেন্টস পারলার। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই গড়ে উঠেছে স্যালন ব্যবসা। নিবন্ধিত পারলারের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো। কিন্তু অনুসন্ধান করতে গিয়ে রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন সন্ধান পান ছয় লাখ পারলারের। অর্থাৎ অর্ধেক পারলার রেজিস্ট্রেশনবিহীন। ছেলেদের মোট পারলার বা সেলুনের সংখ্যা পাঁচ লাখ। বাসার বসার ঘরে কিংবা বারান্দায় কিছু একটা করার উদ্দেশ্য নিয়েই অনেকে খুলে ফেলেছেন নিজস্ব পারলার। চাহিদার কারণেই বাড়ছে পারলারের সংখ্যা। সেটা ইতিবাচকও বটে। তবে গঠনমূলকভাবে পারলারগুলো গড়ে উঠলে বেশি ভালো হবে ভবিষ্যতের জন্য, জানালেন আফরোজা পারভীন।

পারলারের সেবার মাধ্যমে পাওয়া যায় সুস্থ জীবনযাপন। প্রথম দিকে বিষয়টি অনেকেই বুঝতে পারেননি। বিয়ের সাজ, চুল কাটা—এ রকম দু-তিনটি সেবার মধ্যেই মানুষ বেশি থাকতেন। রূপবিশেষজ্ঞরা জানালেন, লি, মে ফেয়ার ও হংকং বিউটি পারলার ছিল একদম গোড়ার দিকে গড়ে ওঠা পারলার। সেটা ষাটের দশকের কথা। সত্তরের দশকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে জেরিনা আসগর খোলেন লিভিং ডল বিউটি পারলার। চীনা পারলারগুলোতে গ্রাহকদের সঙ্গে কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার দেখে অনুভব করলেন নিজের পারলার দেওয়ার। সৌন্দর্যচর্চার পাশাপাশি প্রশিক্ষণও দিতেন তিনি। পল্টনের গাজী ভবনে একটি রুমে দুটি চেয়ার নিয়ে শুরু করেন পারলার যাত্রা। ১৯৯৬ সালে চলে যান গুলশানে। ২২ বছর ছিলেন এই পেশায়। রূপবিশেষজ্ঞ গীতি বিল্লাহ, কানিজ আলমাস খান তাঁর কাছ থেকেই পারলারের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে স্যালনের সংখ্যা বেড়ে যায় দেশে। বেড়ে গেল সেবা নেওয়ার পরিমাণও। নব্বইয়ের দশকে চড়া মেকআপের ধারা দেখা গেল। মেকআপের প্রতিটি টান বোঝা যেতে হবে। তখন পারলারে গিয়ে সাজের প্রতি মানুষের একটা আলাদা ঝোঁক চলে এল। তার আগে পাড়ায় যে মেয়েটা সবচেয়ে ভালো সাজাতে পারতেন, বিয়ের দিন তিনিই প্রতিবেশী কনেকে সাজাতেন। যৌথ পরিবার না থাকার কারণে বাড়িতে আয়োজন করে এখন আর রূপচর্চা করা হয় না। মাথায় তেল লাগিয়ে একটুক্ষণ মালিশ পাওয়ার আনন্দের জন্যই পারলারের শরণাপন্ন হতে হয়। পারলার–সেবা এখন আর বিলাসিতা নয়। সপ্তাহে এক দিন ছুটি থাকে অনেকের। সে সময়টা পরিবারকে দিতে চান। এ কারণে অফিস শেষে অনেকে সেবা নিতে যান। অনেকে পরিবার নিয়ে চলে আসেন। এক–দেড় ঘণ্টার মধ্যে সেবা নিয়ে বের হয়ে যান। সময় বাঁচে।

নিজেকে সতেজ রাখতে অনেকে যান পারলারে
নিজেকে সতেজ রাখতে অনেকে যান পারলারে

অসংখ্য মেয়ে সৌন্দর্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে কাজ করছেন। নারী কর্মজীবীদের মোট সংখ্যার ১৮ শতাংশ পারলারে কাজ করছেন। এ ক্ষেত্র থেকে বার্ষিক আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাঙালি মেয়েদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে আসা মেয়েরা বিশাল একটা জায়গা দখল করে আছেন। দক্ষতা ও কর্মক্ষমতাই সেটার কারণ। ঢাকার ১৫-২০টা পারলার বাদ দিলে পুরো দেশে প্রতিটি পারলারে প্রতিদিন ১০ জন করে গ্রাহক যান। বেশির ভাগ গ্রাহক বিকেলের দিকে যান। এর মধ্যে ৩০ ও ৪০ বছরের ওপরেই বয়সটা থাকে বেশি।

পারলারের মধ্যে আরেকটি সেবা এখন বেশ জনপ্রিয়। সেটি হচ্ছে আয়ুর্বেদিক সেবা। পারসোনা, ফারজানা শাকিল’স, হারমনি স্পা অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা বিউটি স্যালন ইত্যাদি পারলারগুলোয় এই সেবা পাওয়া যায়। রিলাক্সেশন ও সেবা—দুটিই পাওয়া যায় এর মাধ্যমে। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের মাধ্যমে পাওয়া যায় শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি ও সৌন্দর্য। বিউটি স্যালনগুলোয় ঢোকার আগে গ্রাহকের চেহারা থাকে এক রকম। বের হওয়ার সময় দেখা যায় সতেজ সৌন্দর্য। পারলারগুলোর কৃতিত্ব এখানেই। এ কারণেই দিন দিন গ্রাহকদের কাছে পারলারগুলোর গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে ইতিবাচকভাবে।

রয়া 
মুনতাসীর : প্রথমআলোর সহসম্পাদক