গয়নাকথা

গয়নার উপকরণ ও নকশায় নানা বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। মডেল: শবনম ফারিয়া, ছবি: প্রথম আলো
গয়নার উপকরণ ও নকশায় নানা বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। মডেল: শবনম ফারিয়া, ছবি: প্রথম আলো

সুন্দর ছন্দময় ছোট্ট শব্দ গয়না। তবে তার ইতিকথা বিশাল। সেই কবে কখন কোন সময়টিতে নারী গয়নাকে সাজসজ্জার ভূষণ হিসেবে একান্তভাবে গ্রহণ করেছিল, তা সঠিকভাবে সময় নির্ধারণ খুবই দুঃসাধ্য। তারপরও ধারণা করা যায়, সভ্যতার শুরু থেকে বিভিন্ন যুগের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নারী গয়নাকে সাজের অঙ্গ এবং পুরুষেরা নিজের প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখে নিজের অলংকরণ করতে গয়নাকে বেছে নিয়েছে।

প্রাচীন সভ্যতায় চোখ ফেরালে দেখা যায়, গৃহচিত্র থেকে শুরু করে হাজার বছর ধরে নানা ধরনের শিল্পে গয়নার ব্যবহার হয়েছে। প্রাচীন সভ্যতা বলতে এখানে মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, সিন্ধু সভ্যতার কথা বলছি, এসবের যে নমুনা আমরা পেয়েছি, তাতে দেখা যায়, সেই প্রাচীন যুগ থেকে পুরুষ ও নারী নানা ধরনের গয়নায় নিজেকে সজ্জিত করেছে। মিসরের মমির দেহে নানা অলংকার দেখা গেছে, এ ছাড়া মন্দিরের গায়ে যেসব চিত্র–ভাস্কর্য দেখা যায়, তাতে নানা ধরনের নকশাসংবলিত গয়না খুঁজে পাওয়া গেছে। এই গয়নাগুলোর নমুনা দেখে বোঝা যায়, সে সময়ে ফুল, পাতা, বীজ, মাটি, পশুপাখির হাড়, পাখির পালক ও বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার ছিল গয়নায়। তারপরও ধীরে ধীরে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গয়নাশিল্পের নানা ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হয়।

এই পরিবর্তনকে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি। যেমন প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ। আনুমানিক সাত হাজার বছর আগের মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেই সময়ে পুরুষেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি অঙ্গভূষণ ব্যবহার করত। যুদ্ধের প্রয়োজনে এবং সেই অঙ্গভূষণের মধ্যে শিরোভূষণ ও কণ্ঠভূষণের আলংকারিক নকশাগুলো বিখ্যাত ছিল এবং এগুলো ব্রোঞ্জ, পিতল, দস্তা, পশুর চামড়া, হাড়, কাঠসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হতো এবং সম্ভবত সেই সময় থেকে সোনার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে নারীরা গয়নার উপকরণ হিসেবে নুড়িপাথর, পাখির পালক, বীজ, ফুল, লতাপাতা, পশুপাখির হাড় ব্যবহার করে নিজেদের হাতে তৈরি গয়না বানাতে শুরু করে।

বিয়ের গয়নাতেও করা হচ্ছে পরীক্ষা–নিরীক্ষা
বিয়ের গয়নাতেও করা হচ্ছে পরীক্ষা–নিরীক্ষা

আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার সময়ে সোনা ও রুপা দিয়ে গয়না তৈরি শুরু হয়। সেই সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে যেসব মূর্তি ও ভাস্কর্য দেখা যায়, তাতে বিভিন্ন ধরনের অলংকার সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। বিশেষ করে কোনার্ক মন্দির (ভারতের ওডিশা), বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ে, তমলুকের মন্দিরে (মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) যেসব দেবদেবীর মূর্তি দেখা যায়, তাতে বিভিন্ন ধরনের অলংকারের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এই সব অলংকারের মধ্যে মাথার টিকলি, গলার সাতনরি হার, কোমরের চন্দ্রহার, হাতের বাজুবন্ধ, চুড়ি, বালা, রতনচূড়, বিভিন্ন নকশার আংটি, পায়ের খাড়ু, চরণচক্র, কানবালা, কেউর (বাজুবন্ধ), বিছাহার, সীতাহার, কান ঝুমকা (কানঢাকা ঝুমকা), অলংকৃত চিরুনি, অলংকৃত চুলের কাঁটা, মাদুলি, মুকুট বেশি দেখা যায়।

পরবর্তী সময়ে মুসলিম যুগে যখন মোগলেরা ভারতে আগমন করে, তখন অলংকারশিল্পের পরিবর্তন ঘটে। পারস্য থেকে শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত অলংকারের প্রচলন ঘটে। তখন সোনার অলংকারের সঙ্গে দামি রত্নের ব্যবহার শুরু হয়। মোগল রাজকন্যারা সোনার সঙ্গে মুক্তা, হীরা, পান্না, চুনি, নীলা ইত্যাদি রত্ন ব্যবহার করতে পছন্দ করত। বাদশাহ ও বেগমদের মুকুটে রত্নের ব্যবহার ছিল অত্যাবশ্যকীয়। মোগল যুগের গয়না বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

আঠারো শতকের পরবর্তী সময়টিকে গয়নার আধুনিক যুগ। এ সময় এই উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন ঘটে। তার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের সভ্যতার প্রসার লাভ করে। পাশ্চাত্য ঘরানার অলংকারশিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দামি পাথর ও অল্প সোনার ব্যবহার। প্রধানত সেই সময় থেকে সোনার সঙ্গে রুপা, প্লাটিনাম, স্টিল বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে এবং নকশার দিকেও বেশি নজর দেওয়া শুরু হয়।

উনিশ শতক থেকে প্রিসিয়াস মেটালের পরিবর্তে কৃত্রিম উপাদান দিয়ে তৈরি গয়না, যা আমরা কস্টিউম জুয়েলারি হিসেবে এখন চিনি, তার প্রচলন হয়। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এ ধরনের গয়না খুবই জনপ্রিয়তা পায়।

গয়নার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয় যে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত শুধু উচ্চবিত্ত লোকজনই সোনা-রুপাসহ দামি রত্ন ব্যবহার করে আসছে। নিম্নবিত্তের লোকজন তামা, পিতল, কাচ, মাটি ইত্যাদি উপাদানের গয়না ব্যবহার করে। সুতরাং গয়নার সঙ্গে এই শ্রেণিবিভেদ ভীষণভাবে প্রতীয়মান হয়। তবে কম দামি উপাদানের তৈরি গয়না এখন সমানভাবে জনপ্রিয় ও সমাদৃত, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে।

বাংলাদেশে সব সময় সোনার গয়নার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের দিকে সোনার ভরি ছিল ৫২৫ টাকা, নব্বইয়ের দশকের দিকে সেটি হয় চার-ছয় হাজার টাকা। ২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশে সোনার ভরি ছিল আট-নয় হাজার টাকা। আর ২০১৮ সালে সোনার ভরি ৪৫-৫০ হাজার টাকা। সোনার গয়নার দাম নকশার কারণে খুব বেশি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। সে জন্য স্টাইল ও ফ্যাশনের দিক থেকে কস্টিউম জুয়েলারি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিকল্প হিসেবে রুপা ও অন্যান্য ধাতুর ওপর গোল্ড প্লেটিং করে সোনার কারিগর দিয়ে সুনিপুণভাবে গয়না তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া কিছুদিন আগেও সবাই সোনাকে এসেট হিসেবে চিন্তা করত, এখন সে চিন্তাধারাতেও পরিবর্তন এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতারা শুধু গয়না নয়, পোশাক ও অন্য ব্যবহার সামগ্রীতেও নতুনভাবে চিন্তা করছে।

লায়লা খায়ের, গয়না ডিজাইনার এবং কনক দ্য জুয়েলারি প্যালেসের স্বত্বাধিকারী