জীবনধারায় অনলাইন কেনাকাটা

দেশের প্রায় সব শহরেই অনলাইন কেনাকাটা এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো
দেশের প্রায় সব শহরেই অনলাইন কেনাকাটা এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের ব্যাপক প্রসার গত কয়েক বছরে আমাদের জীবনযাপনের ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। আমাদের সামাজিকতা, আমাদের উৎসব, আমাদের বিনোদন—কোনোটিই আর আগের মতো নেই। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর ইউটিউব—আমাদের জীবনকে বদলে দিচ্ছে দ্রুত। আগের মতো এই পরিবর্তন আর শুধু উচ্চবিত্ত আর উচ্চ–মধ্যবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একেবারে নিম্নবিত্তদের মধ্যে না এলেও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ এখন জীবনযাত্রায় বেশ ডিজিটাল! এত দ্রুত পরিবর্তন হওয়া ভালো, না খারাপ—তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য যেকোনো সমাজের মতো আমাদের এখানেও এই পরিবর্তন ঘটছে, আর দিন দিন এই পরিবর্তনের গতি বাড়বে বই কমবে না।

অনলাইন কেনাকাটার যে ধারা ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে, তা অনেক বেশি টেকসই। এর প্রধান কারণ, দেশে অনলাইন শপিং যতটা না শহরের মানুষের কাছে আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি টানে গ্রামগঞ্জের মানুষদের। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত হলেও বাস্তব। বাংলাদেশে যেকোনো বড় শহরে বড় মার্কেটের সংখ্যা অগণিত। শহরের নাগরিকদের নাগালের মধ্যেই বেশির ভাগ জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে থানা বা ইউনিয়ন সদরে অনেক পণ্য কিনতে পাওয়া যায় না। কিন্তু এসব এলাকায় প্রচুর ক্রেতা আছেন, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতাও আছে (দেশে প্রতিবছর বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স আসে, আর সেগুলোর বেশির ভাগ গ্রাম আর ছোট শহরে যায়)। গ্রামীণ এই বাজার দেশে অনলাইন শপিংয়ের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হতে পারে। এখনই দেখা যাচ্ছে, দেশে অনলাইন শপিংয়ের ৫০ শতাংশের বেশি অর্ডার আসে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বিভাগীয় শহরগুলোর বাইরে থেকে।

অনলাইন কেনাকাটার প্রসারে বাধা ও সমাধান 

অনলাইন কেনাকাটা প্রসারের ক্ষেত্রে প্রথম বাধা পণ্য পরিবহন। পণ্য উৎপাদন করা হোক বা আমদানি—সবকিছুই মূলত ঢাকাতেই হয়। অনলাইনে কোনো পণ্যের অর্ডার হলে ঢাকায় তা সেদিন বা পরের দিন পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে অর্ডার দিলে ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যায় ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে। এর প্রধান কারণ, আমাদের দেশে এখনো ই-কমার্সভিত্তিক লজিস্টিকস বা পরিবহন কোম্পানি গড়ে ওঠেনি, যারা সারা দেশের যেকোনো স্থানে প্রোডাক্ট দ্রুত সময়ে পৌঁছে দিতে পারে। ব্যক্তি উদ্যোগে সারা দেশে এ রকম লজিস্টিকস নেটওয়ার্ক তৈরি করা কঠিন, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষও। এই সমস্যার একটি সহজ সমাধান হচ্ছে দেশের ডাকঘরগুলোকে কাজে লাগানো। সারা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১০ হাজারের বেশি ডাকঘর আছে। ই-মেইল আর হোয়াটসঅ্যাপের যুগে এসব ডাকঘরের অবকাঠামো আর জনবল এখন অনেকটাই অব্যবহৃত। এগুলোকে যদি খুব দ্রুত অনলাইন কেনাকাটার সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করা যায়, তবে যেমন এই ডাকঘরগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য আসবে, অন্যদিকে দেশের যেকোনো জায়গায় দুই-তিন দিনে পণ্য খুব কম খরচেই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।

বর্তমানে ই-কমার্স বাজারের আকার বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার ক্রেতা অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দেন। ১৩ থেকে ১৫ লাখ মানুষ বছরে একবার হলেও অনলাইনে অর্ডার করেন।সারা দেশে অনলাইন শপিং ছড়িয়ে দেওয়ার আরও একটি বড় বাধা হচ্ছে ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য। বাংলাদেশে শহর আর গ্রামে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের খরচ ও সহজলভ্যতার মধ্যে ‘আকাশ–পাতাল’ বৈষম্য। আমরা যারা বড় শহরে থাকি, তারা খুব কম খরচে ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করি, সেটি কম্পিউটারে হোক বা ওয়াই–ফাই দিয়ে মোবাইল ফোনে। কিন্তু বড় শহরের বাইরে কার্যত কোনো ব্রডব্যান্ড সেবা নেই! সেই জায়গাগুলোতে ইন্টারনেট মানে একমাত্র টু–জি বা থ্রি–জি (ফোর–জি বেশির ভাগ জায়গায় পৌঁছেনি)। সমস্যা হচ্ছে, মোবাইল ইন্টারনেটে ব্যবহারকারীদের খরচ হয় ‘ডেটা’তে, যত বেশি ওয়েবসাইট দেখা তত বেশি খরচ। দেশে টু–জি বা থ্রি–জি নেটওয়ার্কের ডেটা খরচ এতটাই বেশি যে অনেক মানুষের হাতে স্মার্টফোন থাকলেও তারা ইন্টারনেট নিয়মিত ব্যবহার করেন না ডেটা খরচের ভয়ে! অনলাইন কেনাকাটার সাইট বা অ্যাপে যেহেতু পণ্যের অনেক ছবি থাকে, তাই এগুলো দেখতে অনেক ডেটা খরচ হয়।

অনলাইন কেনাকাটায় আরও একটি বড় বাধা হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। গত কয়েক বছরে হাজার হাজার উদ্যোক্তা অনলাইন শপিং বা ই-কমার্স ব্যবসায় প্রবেশ করেছেন। যেকোনো ব্যবসার মতো এখানেও ‘ভালো-মন্দ’ দুই ধরনের লোকই আছে। দুঃখজনক হলো, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ফেসবুকে তাদের পেজ খুলে ব্যবসা শুরু করে কাস্টমারদের প্রতারিত করছে। এই সংখ্যা সীমিত হলেও ক্রেতারা একবার যদি প্রতারিত হয় বা তাদের পরিচিত কেউ একবার খারাপ অভিজ্ঞতা পায়, তাহলে তারা অনলাইন কেনাকাটার ওপর থেকেই সামগ্রিকভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে, যেহেতু ফেসবুকে যে কেউ একটি পেজ খুলেই বিক্রি শুরু করতে পারে (অনেকের কোনো অফিস বা ঠিকানাও নেই), সেহেতু এসব ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায়ীর কারও কাছে কোনো জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা নেই। গ্রাহক সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ হতে পারে। দেশে এখন অনেক ই-কমার্স কোম্পানি আছে, যারা সব আইনকানুন মেনে ব্যবসা করছে, তাদের নিজস্ব অফিস আছে, ট্রেড লাইসেন্স আছে। গ্রাহকদের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার সুবিধা হচ্ছে এদের সবার ‘রিটার্ন’ আর ‘রিফান্ড’ পলিসি আছে, কোনো সমস্যা হলে আইনগতভাবে সেটার সমাধান করতে তারা বাধ্য। ক্রেতার সমস্যা সমাধান না করতে পারলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘ভোক্তা অধিকার’ অধিদপ্তরে ক্ষতিগ্রস্ত কাস্টমার মামলা বা অভিযোগ জানাতে পারে খুব সহজেই এবং প্রমাণ হলে সেই ই-কমার্স কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। আশা করা যায়, দেশে অনলাইন শপিং যত জনপ্রিয় হবে, আস্তে আস্তে ক্রেতারাও সচেতন হবে এবং এই ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’র সমস্যা ক্রমেই দূর হয়ে যাবে। 

শেষ কথা 

দেশে বর্তমানে ই-কমার্স বাজারের আকার বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার ক্রেতা অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দেন। ১৩ থেকে ১৫ লাখ মানুষ বছরে একবার হলেও অনলাইনে অর্ডার করেন। ভারতে অনলাইন গ্রাহকের এই সংখ্যা ১০ কোটি, চীনে প্রায় ৪০ কোটি। যেখানে ভারতে জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত, সেখানে আমাদের দেশে এখনো জনসংখ্যার ১ শতাংশের কম অনলাইন শপিং করেন। ভারতে বা চীনে ই-কমার্স বা অনলাইন শপিংয়ের এই ব্যাপক বিস্তার শুধু দেশের উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রায় চলে এসেছে। নিঃসন্দেহে আমাদের দেশেও এটি শুরু হয়েছে, কিন্তু কত দ্রুত এটি বিস্তৃত, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, তা নির্ভর করবে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কীভাবে এটির বিস্তারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো দ্রুত এবং সঠিকভাবে নিতে পারেন। 

এ কে এম ফাহিম মাশরুর : বেসিসের পরিচালক এবং আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা