রান্না করা হিমায়িত খাবার

ছবি: খালেদ সরকার
ছবি: খালেদ সরকার

চুইঝাল দিয়ে কষা গরুর মাংস খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে? ঢাকার কোন বাজারে চুইঝাল পাওয়া যায়, খোঁজ নিন। পেলেও পেতে পারেন। না পেলে খুলনায় গিয়ে চুইঝাল কিনে আনুন। গরুর মাংস কিনুন। তারপর রান্না করুন। অবশ্য এত সব ঝক্কি আর অপেক্ষা করতে গিয়ে আপনার চুইঝালের মাংস খাওয়ার সাধ মরে যেতে পারে।

সহজ উপায় কিন্তু একটা আছে। সোজা চলে যান বেঙ্গল মিটের বিক্রয়কেন্দ্রে। চুইঝাল দিয়ে আধা রান্না করা মাংস কিনে এনে ঘরে একটু কষিয়ে নিন। এর ফাঁকে মনে মনে ভাবুন, যুগ কতটা পাল্টে গেছে—আপনার জন্য রান্না করে দিচ্ছে কোনো এক প্রতিষ্ঠান। নগরজীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে। পরিবারের স্বামী–স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী। আপনার জীবনকে সহজ করতে হাজির ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠান, যারা বাজারে হিমায়িত অবস্থায় নানা ধরনের প্রস্তুত ও আধা রান্না করা খাবার বিক্রি করছে।

শুধু চুইঝালের গরুর মাংস নয়, বাজারে আপনি পাবেন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী মজলিশি গরুর মাংস অথবা চট্টগ্রামের মেজবানি মাংস। এগুলো নতুন। অনেক আগে থেকেই বাজারে আছে চিকেন নাগেট, মিটবল, সসেজ, চিকেন রোল, চিকেন কাবাব, কাটলেটসহ বিভিন্ন পদ। এগুলো অবশ্য নানা নামে কোম্পানিগুলো বিক্রি করে। তন্দুরি চিকেনও এখন আধা রান্না অবস্থায় সুপারশপগুলোতে পাবেন, শুধু ওভেনে রান্না করে নিলেই হলো। মাংস ভালো না লাগলে আছে রুটি, পরোটা, শিঙাড়া, পুরি, রোল, সমুচা ইত্যাদি। তাই সকালের নাশতা ও বিকেলে হালকা খাবারের আর চিন্তা রইল না।

ব্যবসায়িক দিক দিয়ে এসব খাবারের বাজারকে বলা হয় হিমায়িত খাদ্য বা ফ্রোজেন ফুডের বাজার। এ বাজারে বিনিয়োগ করেছে গোল্ডেন হারভেস্ট, কাজী ফার্মস, ব্র্যাক, আইজি ফুডস, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, প্যারাগন, আফতাব ফুডস, সিপি, রিচ ফুড, এজি গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, সব মিলিয়ে হিমায়িত খাদ্যপণ্যের বাজারের আকার প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। তবে প্রতিবছর এ বাজার গড়ে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। কোনো কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ বাজারের সম্ভাবনা অনেক। রাজধানীসহ বড় শহরে মানুষের ব্যস্ততা যত বাড়বে, আয় যত বাড়বে—এই বাজারের আকার তত বাড়বে। সেই দিকেই নজর করপোরেটদের।

এখন অবশ্য মানুষ বিকেলের নাশতা ও সন্তানের বিদ্যালয়ে টিফিন হিসেবে দিতে হিমায়িত খাবার বেশি কিনছে। কিছুটা বিশেষ খাবারের প্রতি আকর্ষণ থেকে মানুষ হিমায়িত খাবার কিনছে। কিন্তু দিন দিন এ বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে পণ্যের দাম কমিয়ে আনছে কোম্পানিগুলো। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ নাগাল পাচ্ছে হিমায়িত খাবারের।এখন অবশ্য মানুষ বিকেলের নাশতা ও সন্তানের বিদ্যালয়ে টিফিন হিসেবে দিতে হিমায়িত খাবার বেশি কিনছে। কিছুটা বিশেষ খাবারের প্রতি আকর্ষণ থেকে মানুষ হিমায়িত খাবার কিনছে। কিন্তু দিন দিন এ বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে পণ্যের দাম কমিয়ে আনছে কোম্পানিগুলো। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ নাগাল পাচ্ছে হিমায়িত খাবারের।

অবশ্য যাত্রা বেশি দিনের নয়। এক দশক আগেও দেশের বাজারে বিক্রি হতো মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা রেডি টু কুক পরোটা। এ বাজার থেকে মালয়েশিয়া বিদায় নিতে শুরু করে ২০০৬ সাল থেকে। ওই বছর হিমায়িত খাদ্যের বাজারে আসে গোল্ডেন হারভেস্ট। এখনো সেটি দেশের বাজারের শীর্ষ কোম্পানির একটি। তারা মূলত তিন ধরনের খাদ্যপণ্য বাজারে বিক্রি করে। সকালের নাশতার জন্য রুটি ও পরোটা, বিকেলে হালকা খাবার হিসেবে শিঙাড়া, সমুচা, রোল, আলু ও ডালপুরি ইত্যাদি। আর টিফিন আইটেম হিসেবে তারা চিকেন মিটবল, মিষ্টি ও ঝাল স্বাদের চিকেন উইংস, পপ চিকেন ইত্যাদি মুরগির নানা পদ বিক্রি করে। সব মিলিয়ে মোট ৩৮ ধরনের পণ্য উৎপাদন করে তারা।

ঢাকাসহ বড় শহরের সুপারশপ ও মুদিদোকানে গোল্ডেন হারভেস্টের পণ্য পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন ব্যবস্থাপক মো. হাবিব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, হিমায়িত খাদ্যের বাজারটি খুব দ্রুত বড় হচ্ছে। এখনো এ বাজার বড় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, ‘গোল্ডেন হারভেস্ট এই বাজারের প্রথম কোম্পানি। এত দিন ধরে আমরা বাজারের শীর্ষে অবস্থান করছি, কারণ আমরা ক্রেতাদের ধারাবাহিকভাবে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করছি।’

হিমায়িত খাদ্যের বাজারে ২০১২ সালে প্রবেশ করে বেঙ্গল মিট, যারা ২০০৬ সাল থেকে আধুনিক উপায়ে মাংস বিক্রি করছে। বেঙ্গল মিট বাজারে নানা বৈচিত্র্য এনেছে। শিঙাড়া, সমুচা, চিকেন নাগেট ও মিটবলের মতো সাধারণ পদের পাশাপাশি শামি কাবাব, কাটলেট, গরুর মাংসের বেকন, সসেজ, হ্যাম, পিপার রোস্ট বিফ, স্মোকড বিফ, চিকেন চিজ কাবাব ইত্যাদি বাজারে এনেছে তারা। বেঙ্গল মিট নিজেদের ১৩টি আউটলেট ও ২৩টি কিয়স্কের (ছোট দোকান) মাধ্যমে তারা পণ্য বিক্রি করে। এ ছাড়া সুপারশপে তাদের পণ্য পাওয়া যায়।

বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ এফ এম আসিফ বলেন, ‘আমরা আধা রান্না করা পণ্য নিয়ে এসেছি। এর কারণ, আমরা চাই মানুষ এসব পণ্য ঘরে চুলায় সামান্য কিছুটা রান্না করুক। এতে একেবারে তাজা খাবারের স্বাদ পাওয়া যাবে।’ বাজার সম্প্রসারণের জন্য খাবার হিমায়িত রাখা ও হিমায়িত অবস্থায় সরবরাহ করার জন্য কুল চেইনের মতো অবকাঠামোর উন্নতি দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

কাজী ফুডস ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৪ সালে দেশের বাজারে হিমায়িত খাদ্যপণ্যের ব্যবসা শুরু করে। নিজস্ব খামারে উৎপাদিত মুরগির তৈরি বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি টিজার্স, স্ট্রিপস, স্প্রিং রোল, নাগেটস, পরোটা, পুরি, সমুচা হালকা খাবারও বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের কাজী ফার্মস কিচেন আউটলেট নামের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র আছে। পাশাপাশি সুপারশপ ও সাধারণ মুদিদোকানে তাদের পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ হিমায়িত খাদ্যের বাজারে এসেছে ২০১৩ সালে। প্রতিষ্ঠানটির হিমায়িত খাদ্যের ব্র্যান্ড নাম ‘ঝটপট’। এ ব্র্যান্ডে তারা পরোটা, শিঙাড়া, সমুচা, রুটি, চিকেন স্প্রিং রোল, চিকেন নাগেট, চিকেন পেটি, চিকেন সসেজ, অনথন, পুরি, পপকর্নসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে।

প্রাণ জানিয়েছে, নরসিংদীর ঘোড়াশালে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে হিমায়িত খাদ্য উৎপাদনের কারখানা রয়েছে তাদের। বর্তমানে চাহিদার ১০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে প্রাণের ঝটপট ফ্রোজেন ফুডস। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লার মুদিদোকান ও সুপারস্টোরগুলোতে ঝটপট ফ্রোজেন ফুড পাওয়া যাচ্ছে।

জানতে চাইলে প্রাণ–আরএফএলের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, প্রাণ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিও করছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ইতালি, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে প্রাণের ঝটপট ব্র্যান্ডের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

হিমায়িত খাবার বেশি পছন্দ করে মূলত শিশু ও তরুণেরা। তাদের মধ্যে একজন ঢাকার কাজীপাড়ার ওয়াহিদ আল আহসান। একাদশ শ্রেণির এই ছাত্রী বলেন, বিকেলে যেকোনো রেস্তোরাঁয় এক টুকরা মুরগির মাংস খেতে ১৫০ টাকার মতো ব্যয় হয়। তার বদলে চার টুকরার এক প্যাকেট তন্দুরি চিকেন কিনতে ১৬৫ টাকা ব্যয় হয়।

রাজীব আহমেদ : প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক