পাহাড়ে আলোর শিখা

আনুচিং ও আনাই—খাগড়াছড়ির এই দুই কিশোরী ফুটবলারের কীর্তি এখন সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে। এএফসি অনূর্ধ্ব–১৬বাছাইপর্বে দুর্দান্ত গোলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল দুই বোন।  নীরব চৌধুরী
আনুচিং ও আনাই—খাগড়াছড়ির এই দুই কিশোরী ফুটবলারের কীর্তি এখন সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে। এএফসি অনূর্ধ্ব–১৬বাছাইপর্বে দুর্দান্ত গোলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল দুই বোন। নীরব চৌধুরী

বল পায়ে ডান প্রান্ত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী আনাই মগিনি। পাহাড়ি কন্যার পিছু নিয়েছে দুজন। আটকানোর সুযোগ না দিয়ে আনাই লম্বা করে ক্রস করল গোলমুখে। আরব আমিরাতের রক্ষণভাগের এক খেলোয়াড় ক্লিয়ার করার জন্য হেড করল। কিন্তু বলটি উড়তে উড়তে ডি-বক্সের ভেতরেই পড়ছিল। মাটি ছোঁয়ার আগেই বক্সের ভেতর থাকা আনুচিং আচমকা এক বাইসাইকেল কিক করে বলটি পাঠাল জালে। এ যেন চ্যাম্পিয়নস লিগে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বর্ষসেরা গোলের কার্বন কপি। 

রোনালদো গত মৌসুমে জুভেন্টাসের বিপক্ষে বাইসাইকেল ভলিতে গোল করে মাতামাতি ফেলে দিয়েছিলেন। সেই গোলটিই করে দেখাল খাগড়াছড়ির আনুচিং মগিনি। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে আমিরাতের জালে বাংলাদেশের মেয়েরা সাতবার বল পাঠায়। আনুচিং চারটি গোল করে। এর দুটিতে অবদান সহদোর আনাই মগিনির। দুই বনের যুগলবন্দী।

এই যুগলবন্দী দেখে সেদিন (২২ সেপ্টেম্বর) আনন্দে নেচে উঠেছিল ফুটবল ভক্তরা। নেচেছিল খাগড়াছড়ির সাত ভাইয়াপাড়ার বাসিন্দারা। তাঁদের আনন্দ অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। এই যমজ সহোদর যে তাঁদের পাড়ার বাসিন্দা। আনুচিং-আনাইয়ের কল্যাণে আজ যে পাহাড়ি অজ পাড়াটিকে চিনেছে সারা দেশ। এই দুই পাহাড়ি কন্যা যেন পাড়াটির আলোর শিখা।

যমজ এই বোনদের কীর্তি কারও অজানা নয়। তাদের কথা এখন মুখে মুখে ফিরছে খাগড়াছড়িতে। শুধু এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬তে নয়, আকর্ষণীয় গোল আরও করেছে আনুচিং এবং আনাই। আগস্ট মাসে ভুটানের বিপক্ষে ডি–বক্সের মুখ থেকে সাইড ভলিতে দুর্দান্ত একটি গোল করে কাঁপিয়ে দেয়। একই ম্যাচে আনাই ২৫ গজ দূর থেকে শট নিয়ে গোল করে।

একসময় অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করা দিনমজুর রিপ্রু মগিনি ও আপ্রুমা মগিনি এখন ঘরে বসেই মেয়েদের খেলা দেখেন। মেয়েদের এমন কৃতিত্বের পর পরিবারে কিছুটা সচ্ছলতা এসেছে। যে ঘরে একসময় কুপি বাতি জ্বলত সেখানে চলছে টেলিভিশন।

‘খুব অভাবের সংসার ছিল আমার। মেয়েদের খাওয়াতে পারতাম না। জমি নেই। টাকা নেই। সেই মেয়ে দুটিই আজ আমার একমাত্র সম্বল। এই দুজনই আমার সঙ্গে থাকে। এখন তারা কিছু টাকা–পয়সা দেয়। ইচ্ছা আছে একটা জমি কেনার।’—এইভাবে অতীত এবং বর্তমানের দুই রকমের চিত্র তুলে ধরলেন রিপ্রু মগিনি।

আনাই ও আনুচিংয়ের জন্ম দুই মিনিটের ব্যবধানে। চার বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে দুজনই সবার ছোট। বড় ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইয়েরা আলাদা থাকে। রিপ্রু-আপ্রুমা দম্পতির একমাত্র সম্বল এই দুই মেয়ে। স্বামী–স্ত্রী দুজনে মাঠঘাটে কাজ করে দুই মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছিলেন। দিন বদলের গল্প সেখান থেকেই শুরু। রিপ্রু বলেন, ‘স্কুল এবং পাড়ায় ছেলেদের সঙ্গে দুই বোন ফুটবল খেলত। কখনো খেলার জন্য বাধা দিইনি। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী খেলেছে। মাঝেমধ্যে মেডেল নিয়ে আসত। স্কুলপর্যায়ে খেলার সময় লোকজন বলত মেয়েরা ভালো খেলে। শুনে ভালো লাগত।’

সাফল্যের স্মারক হাতে খাগড়াছড়ির সাত ভাইয়াপাড়ায় বাড়ির সামনে দুই বোন। প্রথম আলো
সাফল্যের স্মারক হাতে খাগড়াছড়ির সাত ভাইয়াপাড়ায় বাড়ির সামনে দুই বোন। প্রথম আলো

ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট ও ভলিবল খেলত দুজন। তবে ফুটবলের প্রতি ছিল আলাদা আকর্ষণ। খেলার মাঠে মেয়ে পাওয়া যেত না বলে ছেলেদের সঙ্গে খেলতে হতো তাদের। দুই সহোদর ২০১১ সালের বঙ্গমাতা ফুটবলের মাধ্যমে প্রথম নজর কাড়ে। এরপর খাগড়াছড়ি জেলা দলের হয়ে খেলে তারা। ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা দলের হয়ে অংশ নেয় তারা। কারণ তখন খাগড়াছড়ি জেলায় মেয়েদের দল ছিল না। ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলে জায়গা করে নেয় তারা। তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে পাঁচটি গোলও করে আনুচিং। এরপর থেকেই জাতীয় এবং বয়সভিত্তিক দলের অপরিহার্য দুই বোন।
আপ্রুমা মেয়েদের কারণে আজ নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ অসচ্ছল পরিবারটি আজ সচ্ছল হয়েছে তাদের জন্য। নিজের দুটি মেয়েকে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় দেখতে চান তিনি।

টেলিভিশন এবং পত্রিকায় দুই মেয়ের ছবি দেখে আনন্দে বুক ভরে ওঠে তাঁদের। ঘরে দুই মেয়ের অনেক মেডেল। আনুচিং এবার এসএসসি পাস করেছে। আনাই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। বাবা-মায়ের ইচ্ছা পড়ালেখাটাও যেন তারা চালিয়ে যায়। আনাই খেলে রক্ষণভাগে। আনুচিং খেলে স্ট্রাইকার পজিশনে। প্রায় ম্যাচে আনুচিংয়ের গোল থাকে। তবে কম যান না আনাই মগিনিও। রক্ষণ থেকে ওভারল্যাপ করে ওপরে ওঠে সেও গোল করে।

খাগড়াছড়ির সাত ভাইয়াপাড়াটিতে প্রায় শ খানেক পরিবারের বসবাস। পাড়াটিতে যাওয়ার জন্য একটি সেতুও নেই। তবু মারমা পরিবারটিকে নিয়ে গর্ব করেন পাড়া–প্রতিবেশীরা। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর যখন দুই বোন বাড়ি ফিরেছিল, তখন তাদের দেখতে পাড়া–প্রতিবেশীদের ভিড় লেগে যায়। অনেকে দুই বোনের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। এসব দেখতে দেখতে গর্বে বুক ভরে ওঠে স্বামী-স্ত্রীর। শুধু পরিবারের নয়, আনুচিং-আনাই হয়ে উঠেছে পাহাড়ের আলোর শিখা।

তাজিকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে এএফসি কাপে অংশ নিয়ে ২৭ অক্টোবর দেশে ফিরেছেন আনুচিং-আনাইচিং। এরপর ৪ নভেম্বর ছুটে যান তাঁদের মা-বাবার কাছে, খাগড়াছড়িতে। মাত্র চার দিনের ছুটি। স্বজনদের সান্নিধ্যে কেটে যায়। ঢাকায় ফিরে আবার ফুটবল নিয়ে মাতবেন তাঁরা। তাঁদের ধ্যানজ্ঞানে এখন কেবল ফুটবল। ফুটবল নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন।
আনুচিং বলেন, একদিন মেয়েদের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অংশ নেবে। আর সেই দলে দুই বোন খেলব। এমন স্বপ্ন দেখি।’