ভালোবাসার গল্পের শেষাংশ

নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ে পোক্ত অবস্থান চট্টগ্রামের ছেলে ইরফান সাজ্জাদের।  সংগৃহীত
নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ে পোক্ত অবস্থান চট্টগ্রামের ছেলে ইরফান সাজ্জাদের। সংগৃহীত

‘সাত বছর আগে ঢাকায় আসি। বাসা ভাড়া দিতেই হিমশিম খেতাম। ধারদেনা করে চলতে হয়েছে। বন্ধু ও পরিচিতজনেরা সাহায্য করতেন। এই ঢাকায় কখনো গাড়ি চালাব, ভালো কোনো বাসায় থাকব, ভালোমতো খেতে পারব—এসব ছিল ভাবনার অতীত। কী রকম কষ্টে জীবন কেটেছে তা কেউ বিশ্বাস করতেও পারবে না।’ কথাগুলো এ প্রজন্মের জনপ্রিয় অভিনেতা ইরফান সাজ্জাদের।

চট্টগ্রামের মোহরা এলাকার ছেলে ইরফান সাজ্জাদ এখন তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় অভিনেতাদের একজন। অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়েই ঢাকায় যান। উত্তরায় জীবনযাপন শুরু করেন। এখনো সেখানেই আছেন, তবে ঘরবাড়ি বদল হয়েছে। ইরফানের জীবনে এখন আর সেই টানাপোড়েন নেই। দুই বছর ধরে মাসের প্রায় সব দিনই নাটকের শুটিং করেন। আয়–রোজগারও বেশ ভালোই।

ইরফানের পরিবারের ত্রিসীমানায়ও কেউ অভিনয়ের সঙ্গে ছিল না। তিন ভাইয়ের গান আর অভিনয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় ইরফানের এই আগ্রহ তীব্র হয়। বড় ভাই শাহাদাৎ হোসাইন লিটন তাঁর মাথায় অভিনয়ের বীজ ঢুকিয়ে দেন। ইরফান বললেন, ‘লিটন ভাই আমাদের ধরে নিয়ে থিয়েটার করাতেন। প্রথম যেদিন অভিনয় করি, সেদিন দর্শক ছিল পাঁচ শর মতো। আমার অভিনয় শেষ হলে সবাই যেভাবে হাততালি দিয়েছিল, তা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।’

ইরফানের স্কুলজীবন কেটেছে মোহরার এএল হাইস্কুলে। এসএসসি পাস করেন এখান থেকেই। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর ইরফান ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে থাকেন। পড়াশোনার চাপ থাকায় কলেজে আর অভিনয় নিয়ে ভাববার সময় পাননি। ২০০৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা শেষে অভিনয়ের ভূত আবার মাথায় ঢোকে ইরফানের। বললেন, ‘পরীক্ষার পর সময় পাই। চট্টগ্রামের প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। টুকটাক মডেলিংও করতাম। ব্যান্ড করতাম বলে আমার স্ত্রী শারমীন সাজ্জাদের (তখন ওর সঙ্গে আমার প্রেম চলছিল) বাড়ির লোকজনের ধারণা ছিল আমি খুব খারাপ ছেলে। লম্বা লম্বা চুল। কত কিছু যে ঘটেছে আমার জীবনে.... হা হা হা।’
একটা সময় উচ্চশিক্ষার জন্য চট্টগ্রামের কমার্স কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক পড়া শুরু করেন। এর মধ্যেই ভালোবেসে বিয়ে করে ফেলেন ইরফান ও শারমীন। এক পরিবার মেনে নিলেও আরেক পরিবার মেনে নেয়নি তখন। অকুল পাথারে পড়ে যান ইরফান। স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রামের চকবাজারে বড় বোনের বাসায় গিয়ে ওঠেন। চার মাস থাকার পর একটা চাকরি পেয়ে যান। পাড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতে থাকেন। সংসার ও পড়াশোনার চাপে অভিনয়ের কথা ভাবার সময়টাও ছিল না। চিন্তা করলেন, অভিনয়ে নিজের স্বপ্নের যদি বাস্তবায়ন করতে হয় তাহলে ঢাকায় যেতে হবে। আবার ঢাকায় গেলেই তো চলবে না। জীবন চালাতে হলে আয় দরকার। জাপানভিত্তিক ‘ব্রাদার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ঢাকা অঞ্চলের ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগ পান। ইরফান বলেন, ‘চট্টগ্রামের থাকার সময় পার্টটাইম মার্কেটিংয়ের কাজের অভিজ্ঞতার কারণে আমি ঢাকায় চাকরিটি পেয়ে যাই। বেতন ছিল ২০ হাজার টাকা। বউ নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় একটি বাসা ভাড়া নিই। টেনেটুনে সংসার চালাতাম।’
এ সময় চ্যানেল আইয়ের রিয়েলিটি শো ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসামের’ বিজ্ঞাপনটি দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন, নাম লেখাবেন। নিজেকে এই রিয়েলিটি শো দিয়ে অভিনয়ের রাস্তায় এগিয়ে নেবেন। স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে নাম লেখালেন। টিকেও গেলেন। ক্যাম্পজীবন শুরু হয়। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসব করেন। একটা সময় অফিস এটা টের পেয়ে যায়। ইরফান বলেন, ‘আমাকে দুটি অপশন দিয়ে দেওয়া হয়। হয় চাকরি করো, নাহয় ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম নিয়ে থাকো। দোটানায় পড়ে যাই। শারমীনের সঙ্গে আলাপ করলাম। তাঁর কথাগুলো ছিল হুবহু এ রকম। তোমার কি মনে হচ্ছে, তুমি চ্যাম্পিয়ন হতে পারবা? আমি তখন বললাম, যদি তুমি সহযোগিতা করো আমি এগিয়ে যেতে পারব।’
সেটা ২০১৩ সাল। ইরফান ব্যস্ত রিয়েলিটি শো নিয়ে, আর শারমীন নিয়েছে একটা খণ্ডকালীন চাকরি। সেই টাকায় সংসার চলে না। একটা অনিশ্চয়তা, আদৌ সেরা হতে পারব কি না? তবে একটা বিশ্বাস ভেতরে ঠিকই ছিল। এই বিশ্বাসই হয়তো আমাকে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব এনে দিয়েছিল।’
ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কয়েক মাস পর নাটকে অভিনয় শুরু করেন। প্রথম নাটকটি ছিল মাবরুর রশিদ বান্নাহর ভালোবাসার গল্পের শেষাংশ। এই নাটকে আমি অভিনয় করি নুসরাত ইমরোজ তিশার বিপরীতে। একে একে নাটক আসতে থাকে হাতে। ২০১৫ সালের পর থেকে পাল্লা দিয়ে ব্যস্ততা বাড়ল। মাসে ২৫ দিন শুটিং শুরু করেন। আয়–রোজগার বাড়তে থাকে। ইরফান বলেন, ‘অনেক ভালো ভালো গল্পে অভিনয় করলেও, আমার জীবনের শুরুর দিকে শ্রেষ্ঠ নাটক হচ্ছে, মেহজাবিনের বিপরীতে হঠাৎ নীরার জন্য, এনটিভিতে এই নাটকটি প্রচারের পর সমালোচকের প্রশংসা যেমন পেয়েছি, তেমনি জনপ্রিয়তাও পেয়েছি।’
চার বছরে তিন শতাধিক নাটকে অভিনয় করা হয়ে গেছে বলে জানান ইরফান। গুণী নির্মাতাদের এসব নাটকে সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন দারুণ সব অভিনয়শিল্পীকে। টেলিভিশন নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি। দুটি ছবি হচ্ছে মুশফিকুর রহমান গুলজারের মন জানে না মনের ঠিকানা ও তানিয়া আহমেদের ভালোবাসা এমনই হয়। যে ইরফান ঢাকা শহরে জীবনযাপন করতে হিমশিম খেতেন, সেই ইরফান এখন অভিনয়ের জন্য দেশের বাইরেরও নিয়মিত যান। ইরফান বলেন,‘সাত বছর আগে ঢাকায় এসেছিলাম অনিশ্চিয়তাকে সঙ্গী করে। আজ মনে করি, রাজধানী ঢাকাকে জয় করতে পেরেছি। দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছি।’