সীমানা ছাড়িয়ে কারাতেকন্যা

লতা পারভীন পুলিশ বাহিনীর প্রথম নারী  সদস্য হিসেবে ব্ল্যাক বেল্ট পান। কারাতে প্রতিযোগিতায় অান্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের একমাত্র নারী বিচারক।  প্রথম আলো
লতা পারভীন পুলিশ বাহিনীর প্রথম নারী সদস্য হিসেবে ব্ল্যাক বেল্ট পান। কারাতে প্রতিযোগিতায় অান্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের একমাত্র নারী বিচারক। প্রথম আলো

শৈশবে সবার কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ডানপিটে। আর এখন দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক নারী কারাতে বিচারকের খাতায় নামটি উঠে এসেছে। তাঁর নাম লতা পারভীন। সবাই তাঁকে কারাতেকন্যা হিসেবে চেনে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি পেয়েছেন স্বর্ণ ও রৌপ্যপদক। হয়রানির শিকার নারীরা লতাকে দেখে নতুন করে বাঁচতে শিখছেন। হয়ে উঠছেন আত্মবিশ্বাসী। জয় করছেন ভয়কে। 

লতা পারভীন বর্তমানে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) হিসেবে কর্মরত আছেন। পুলিশ বাহিনীর প্রথম নারী সদস্য হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশন থেকে ব্ল্যাক বেল্ট পান তিনি। ২০১৪ সাল থেকে টানা তিন বছর পুলিশ বাহিনীর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কারাতেতে প্রথম হয়েছেন তিনি। একই সময়ে জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় ২০১৪ ও ২০১৬ সালে পান রৌপ্যপদক।
আন্তর্জাতিক কারাতে প্রতিযোগিতায় ২০১৫ সালে দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয় লতার। সে বছরের জুলাই মাসে জাতীয় দলের হয়ে ভারতের কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন। এতে স্বর্ণপদক পান লতা। এ প্রতিযোগিতায় ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ ছয়টি দেশ অংশ নেয়। এপরপর ২০১৬ ও ১৭ সালেও স্বর্ণপদক পান তিনি। এতে সিঙ্গাপুর, জাপান, ভারত, নেপালসহ আটটি দেশ অংশ নেয়।
২০১৭ সালের আগস্টে এশিয়ান কারাতে ফেডারেশনের একমাত্র বাংলাদেশি নারী বিচারক হন লতা পারভীন। এরপর গত জুলাই মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় তিনি বিচারক হিসেবে ছিলেন। লতা বিচারক হওয়ার ২০ বছর আগে দেশের আরেকজন নারী বিচারক হিসেবে ছিলেন। হারানো সেই মুকুটটি আবার ফিরিয়ে আনলেন লতা।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, লতা পারভীন এখন শুধু বাংলাদেশ পুলিশের গর্ব নন। পুরো দেশের গর্ব। এশিয়ান কারাতে ফেডারেশনে দেশের একমাত্র নারী কারাতে বিচারক তিনি। এর আগে বিদেশের মাটিতে কারাতে ইভেন্টে লতা প্রথম স্বর্ণপদক বিজয়ী পুলিশ সদস্য। তিনি দেশেও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁকে অনুসরণ করে অনেক নারী পুলিশ সদস্য কারাতে শিখতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। দেশের সাহসী তরুণীদের কাছেও তিনি হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয়।
শুধু কারাতে নয়, বক্সিং, কুস্তি, ভলিবল খেলাতেও সমান পারদর্শী লতা পারভীন। পুলিশ বাহিনীর সেরা নারী খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। গত বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সাহসিকতার জন্য পুলিশ বাহিনী তাঁকে ‘মেডেল অব কারেজ’ পুরস্কার দিয়েছে।
পঞ্চগড়ের ড. আবেদা হাফিজ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করেন লতা। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। ২০১০ সালে কনস্টেবল পদে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ৮২ জন নারী সদস্যের জন্য প্রথমবারের মতো বাহিনীর পক্ষ থেকে কারাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। চার মাসের প্রশিক্ষণ শেষে দেখা গেল, আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে লতা পারভীন। এরপর একাকী অনুশীলন চালিয়ে যান এই নারী কনস্টেবল। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত বিশেষ ম্যাগাজিনে লতা পারভীনকে পুলিশ বাহিনীর অহংকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর পেছন তাকাতে হয়নি লতাকে। তাঁর সাহস ও নৈপুণ্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে দেশ–বিদেশে।
লতা বলেন, এখন মেয়েরা ভয়কে জয় করতে শিখছে। রাস্তায় চলার সময় অনেক মেয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকে। কারণ, তারা কারাতে জানে। যেকোনো পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করছে তারা।
নিজের সাফল্যের জন্য লতা তাঁর স্বামী, পরিবার, সহকর্মী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেন না। স্বামী কাউসার আহমেদ চিটাগাং কারাতে অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান কোচ। তাঁদের ছয় বছর বয়সী একমাত্র ছেলেও মা-বাবার পথ ধরে কারাতে শিখছে। লতা চান, সব নারীই আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করুক। অবসরে নিজ উদ্যোগে বিনা খরচে তরুণীদের কারাতে প্রশিক্ষণ দেন (সপ্তাহে দুই দিন) তিনি। আত্মরক্ষার জন্য সব নারীর কারাতে জানা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ভবিষ্যতে নারীদের জন্য কারাতে একাডেমি করার স্বপ্ন রয়েছে কারাতেকন্যা লতার।