বাংলাদেশের রিকশাচিত্র

রিকশাচিত্রে কল্পিত রাজধানী
রিকশাচিত্রে কল্পিত রাজধানী

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চারুকলার ধারার পাশাপাশি একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারাও গড়ে ওঠে। এর নেতৃত্ব দেন পীতলরাম সুর, আর কে দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ উস্তাদ প্রমুখ শিল্পী। এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীর মাধ্যমেই বিকশিত হয় এ দেশের সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, রিকশা আর্ট, ট্রাক আর্ট ইত্যাদি। আর এগুলোর মধ্যে যেটি নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তায় ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে সুধীজনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সেটি হলো রিকশা আর্ট।
যেমন, ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে (বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত) শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের সুসজ্জিত ও চিত্রিত রিকশা সংগৃহীত আছে। জাপানের ফুকুয়োকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে এবং এই মিউজিয়ামে রিকশা পেইন্টিংয়ের একটা বড় সংগ্রহ আছে। সম্প্রতি (২০১৩) জাপানের তাকামাতসু শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। নেপালেও হয়েছে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী। তবে বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এ প্রদর্শনীতে ৫০০ জন রিকশা পেইন্টার এবং ৮৩ জন বেবিট্যাক্সি (দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট অটোরিকশা) পেইন্টারের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল।

শাওন আকন্দ: শিল্প-সমালোচক
শাওন আকন্দ: শিল্প-সমালোচক

২.
মূলত চাকা আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে রিকশা নামের এই বাহনের সূত্রপাত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, ১৮৭০ সাল নাগাদ। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম রিকশার প্রচলন ঘটে কলকাতায়, বিশ শতকের প্রথম ভাগে। কাছাকাছি সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রিকশার প্রচলন হয় প্রথমে ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে এবং পরে ঢাকায় (১৯৩৮)। তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশে রিকশার আগমন ঘটেছিল কলকাতা থেকে। ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার একজন বাঙালি জমিদার এবং ওয়ারী অঞ্চলের একজন মাড়োয়ারি ভদ্রলোক ছয়খানা রিকশা কিনে ঢাকায় প্রচলন করেন বলে জানা যায়। তবে বাংলাদেশে প্রচলন ঘটে সাইকেল রিকশার, মানুষে টানা রিকশা নয়। বাহারি ও শৌখিন পরিবহন হিসেবে ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটে ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর। ক্রমেই তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত রিকশা পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত হয় এই সময় থেকেই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে রিকশা পেইন্টিং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হতে থাকে। বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রবীণ ও বিখ্যাত শিল্পী যেমন—আর কে দাস, আলী নূর, দাউদ উস্তাদ, আলাউদ্দিনসহ অন্যরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকেই রিকশা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, রিকশা পেইন্টিংয়ের চাহিদা ছিল তখন অনেক বেশি। তাঁদের অনেকে আগের পেশা বা পৈতৃক পেশা ছেড়ে এই পেশায় যুক্ত হন। যেমন আর কে দাশের পৈতৃক পেশা ছিল চামড়ার কাজ। তিনি ও তাঁর ছেলেরা এসেছেন রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজে।
একটি রিকশা তৈরি থেকে রাস্তায় নামা পর্যন্ত ছয় শ্রেণীর পেশাজীবীর হাত ঘুরে আসে। তাঁরা হলেন,
হুড মিস্ত্রি: এঁরা রিকশার হুডে রেক্সিন দিয়ে অ্যাপ্লিক-সদৃশ অলংকরণের কাজ করেন।
বডি মিস্ত্রি: এঁরা রিকশার মূল কাঠামো নির্মাণ করেন।
বাতা কারিগর: রিকশার হুড বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি করেন এই কারিগরেরা।
পেইন্টার: রিকশার চৌকোনো বোর্ড ও পেছনে বডির গায়ে পাতলা টিনের শিটের ওপর ছবি আঁকেন এঁরা। এঁরাই মূলত রিকশা পেইন্টার।
রংমিস্ত্রি: এঁরা চাকার ওপর ধাতু নির্মিত ‘মাডগার্ড’সহ অন্যান্য ধাতব অংশে আলপনার মতো রং করে থাকেন।
ফিটিং মিস্ত্রি: রিকশার বিভিন্ন যন্ত্র যথাস্থানে সংস্থাপনের কাজ করেন এঁরা।
করণকৌশলের দিক থেকে রিকশার অঙ্গসজ্জাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর এক ভাগে রয়েছে রেক্সিন, প্লাস্টিক, আয়না, ঘণ্টা বা বাতিল সিডি ও অন্যান্য উপকরণে রিকশা অলংকরণ (টিন কেটে বিভিন্ন কারুকাজ করার উদাহরণও দেখা যায়) এবং অন্য দিকে রয়েছে রঙের সাহায্যে রিকশাকে চিত্রিত করার বিষয়টি। তবে একটি নতুন রিকশাকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলায় রিকশা পেইন্টারদের বিশেষ কৃতিত্ব দিতেই হবে।

বাংলাদেশের রিকশাচিত্র
বাংলাদেশের রিকশাচিত্র


৩.
রিকশা আর্টের মূল লক্ষ্য রিকশাকে সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করা। সাধারণত শিল্পীরা মহাজন এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ছবি এঁকে থাকেন। তবে গত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে রিকশা পেইন্টিং করা হয়েছে। যেমন, ষাটের দশকে রিকশা পেইন্টিং করা হতো মূলত শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র তারকাদের প্রতিকৃতি অবলম্বনে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে। আবার সত্তরের দশকে নতুন দেশের নতুন রাজধানী হিসেবে ঢাকা যখন বাড়তে শুরু করে, তখন কাল্পনিক শহরের দৃশ্য আঁকা হতো রিকশায়। পাশাপাশি সব সময়ই গ্রামের জনজীবন, প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিও আঁকা হতো, এখনো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টাইলের ফুল, পাখি ইত্যাদি তো আছেই।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি রিকশায় মানুষের ছবি আঁকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে রিকশা পেইন্টাররা মানুষের ৬ পৃষ্ঠার পর পরিবর্তে পশুপাখির ছবি আঁকতে শুরু করেন। যেমন, ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে একটা শিয়াল, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা বাঘ, পাশে স্কুল বালকের মতো ব্যাগ কাঁধে খরগোশ ছানা চলেছে স্কুলে। এ ছাড়া বিভিন্ন মিথ বা ধর্মীয় কিংবদন্তিকে বিষয় করে রিকশায় ছবি আঁকা হয়। যেমন, মুসলিম উপাখ্যানের দুলদুল, বোরাক কিংবা আরব্য রজনীর উপাখ্যান—আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ও দৈত্য, রাজকন্যা, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাদায় আটকে যাওয়া গরুর গাড়ির ছবিটি (‘সংগ্রাম’ নামে পরিচিত) রিকশাচিত্রীরা বিভিন্নভাবে এঁকেছেন। ভিনদেশি দৃশ্য, যেমন, মরুভূমির ভেতর উট নিয়ে চলেছে দুই বেদুইন কিংবা অচেনা কোনো সমুদ্রসৈকতে খেলা করছে কোনো বালক, জাপানের কোনো বাড়ি, লন্ডন ব্রিজ, আইফেল টাওয়ার, টাইটানিক জাহাজ ইত্যাদি। স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার ইত্যাদি স্থাপত্য রিকশাচিত্রের বিষয় হয়েছে বহুবার। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন তাজমহল রিকশা পেইন্টিংয়ের আরেকটি জনপ্রিয় বিষয়। ইদানীং রিকশাচিত্রীদের আরেকটি প্রিয় বিষয় যমুনা সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু)। এ ছাড়া ডাইনোসরের সঙ্গে যুদ্ধরত লুঙ্গিপরা খালি গায়ের বাঙালি—রিকশাচিত্রীদের অপূর্ব কল্পনাশক্তির নিদর্শন।

রিকশা পেইন্টিংয়ে লোকায়ত ধারার প্রভাব, বিশেষ করে রেখার ব্যবহারে অধিক চোখে পড়ে। আবার বিভিন্ন ক্যালেন্ডার বা ছাপা ছবিকে মূল হিসেবে ব্যবহার করে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়েও রিকশা পেইন্টাররা ছবি এঁকে থাকেন। তবে রিকশা পেইন্টিংয়ে, বিশেষ করে রং নির্বাচনে, সিনেমার ব্যানার চিত্রীদের কাজের প্রভাব পড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। ইদানীং রিকশা পেইন্টারদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধারার শিল্পীদের যৌথ আর্ট ওয়ার্কশপের সংবাদও জানা যায়। আবার কোনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধারার শিল্পীর কাজে রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রভাবও লক্ষ করা যায়।

৪.

বাংলাদেশের রিকশাচিত্র
বাংলাদেশের রিকশাচিত্র

তবে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ইদানীং ঢাকার রিকশাচিত্রীরা, যাঁরা এখনো সক্রিয়, তাঁরা মূলত বিদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল।
বিদেশিদের শখ মেটানো গেলেও তাতে রিকশাচিত্রীদের জীবনে, দু-একটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে বিশেষ কোনো হেরফের হয়েছে—এমনটা মনে হয় না। বরং হাতে আঁকা প্লেটের বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বিশেষ রীতির চিত্রকলা আজ হুমকির সম্মুখীন। পেশাগত দিক দিয়ে হুমকির সম্মুখীন রিকশা পেইন্টাররা। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ রিকশাচিত্রী পেশা পরিবর্তন করেছেন বা বিকল্প কাজ খুঁজে নিয়েছেন। ঢাকায় বর্তমানে (এপ্রিল ২০১৪) আনুমানিক ১০-১২ জন সক্রিয় রিকশাচিত্রী আছেন। ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, পাবনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ইত্যাদি শহরে আরও কিছু রিকশাচিত্রী কমবেশি কাজ করেন।
বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর চারুশিল্পের ইতিহাসেও বিশেষ ধরন বা শৈলী হিসেবে রিকশা পেইন্টিং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারার বিলুপ্তি ঘটলে পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য শৈলীর অবসান ঘটবে। তবে আশার কথা, সম্প্রতি বাংলাদেশে রিকশাচিত্র নিয়ে কিছু কিছু উদ্যোগের খবর জানা যাচ্ছে। তার পরও এই প্রশ্ন থেকেই যায়, দ্রুত পরিবর্তনশীল এই সময়ে ‘রিকশার শহর’ ঢাকা থেকে রিকশা কি একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে? সেই সঙ্গে কি হারিয়ে যাবে রিকশা আর্ট? বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পশৈলী—রিকশা আর্টের শেষ গন্তব্য কি হবে জাদুঘর? আমার ধারণা, বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
শাওন আকন্দ: শিল্প-সমালোচক

বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক ক্যানভাস
বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক ক্যানভাস