যুদ্ধদিনের গল্প

দেশের সাহসী সন্তানেরা নয় মাস যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। ছবি: সংগৃহীত
দেশের সাহসী সন্তানেরা নয় মাস যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা সাধারণ নাগরিকের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। ২৬ তারিখ সারা দিন ধরে চলে কারফিউ। ২৭ মার্চ ঘণ্টা দুয়েকের জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। সকাল নয়টা থেকে বেলা ১১টা।
আমার মা শামসুন নাহার ইসলাম ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। আমরা তখন ধানমন্ডি থাকি। আমি পড়ি রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, প্রথম বর্ষে। মা আমাকে নিয়ে শহরের পরিস্থিতি দেখতে বের হলেন। আমরা একটা রিকশায় চড়লাম। নিউমার্কেটে দেখলাম, রাতে যেসব রিকশাওয়ালা রিকশায় ঘুমুচ্ছিল, তারা ঘুমন্ত অবস্থাতেই মারা গেছে।
শহীদ মিনারটিকে দেখে কান্না চলে এল। পুরো মিনারটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। জগন্নাথ হলের প্রতিটা জায়গায় রক্ত। মাঠের এক কোনায় দেখলাম, কোনো জায়গায় গর্ত খুঁড়ে ভরাট করলে যেমনটি হয়, সে রকম মাটির ছোট্ট ঢিবি। আসলে ওটা একটা গণকবর। সেখানে কারও হাত, কারও পা, কারও মাথার খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। কণ্ঠ ভারী হয়ে এল।
সময় ফুরিয়ে আসছিল। আমরা বাসায় ফেরার জন্য রওনা হই। সবকিছু দেখে আমি থমকে গিয়েছিলাম। মেনে নিতে পারছিলাম না। মা আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছিলেন। বললেন, ‘এত কিছু দেখার পর, বলো তোমার কী করা উচিত?’ আমি বললাম, ‘আমার প্রতিশোধ নেওয়া উচিত।’ মা বললেন, ‘প্রত্যেক মা স্বার্থপর, আমিও স্বার্থপর। তবু আমি আমার সবচেয়ে সাহসী ছেলেটিকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে রাজি আছি।’
৭ এপ্রিল আমি বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। লক্ষ্য একটাই। দেশের জন্য যুদ্ধ করা। মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, ‘আমার তিনটি কথা মনে রাখবে। দেশের জন্য যুদ্ধ যখন তুমি করবেই, তাহলে বীরের মতো যুদ্ধ করবে। মরতে হলে বীরের মতো মরবে। আর ফিরে আসতে হলে বীরের মতো ফিরবে।’
যুদ্ধে যোগ দিলাম।
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর সিলেট দখল করার উদ্দেশ্যে আমরা কানাইঘাট নদীর দক্ষিণ ঘাটে অবস্থান করছি।

মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান
মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান

কানাইঘাটের দক্ষিণ পাশে আমরা যখন প্রতিরক্ষা অবস্থানে (ডিফেন্স), পরদিন ভোরে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি আমার ডিফেন্স পজিশনে ডান দিক থেকে হামলা শুরু করল। তারা আমাদের একটা অংশ দখল করে নিল। সেখানে আমার দলের ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা আটকা পড়লেন। আমি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁদের বলি, ‘আপনারা জায়গা ছাড়বেন না। পুকুরের পাড়ের নিচে চলে যান। পাড়ের দিকে চোখ রাখুন। আপনাদের মারতে হলে তাদের পাড়ে উঠতে হবে। পাড়ে উঠলেই আমরা গুলি করব।’ সুবেদার মুসাকে বললাম, ‘আপনি পাড়ের ওপরে মাথা তুলবেন না। আমরা এক্ষুনি পাঞ্জাবির ওপর ফায়ার ওপেন করব। আপনার ডিফেন্সের ওপর দিয়ে আমরা গুলি চালাব। ওই ফায়ারিং সাপোর্টে আমি আপনার ডিসেন্সে পৌঁছে যাব। তারপর পাকিস্তানিদের হামলা করব।’
আমি ও আমার দলের ৪০ জন গেরিলা যোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করি। গুলি চালাতে চালাতেই আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম। মুহূর্তে একটা বিভ্রম তৈরি হলো। কারণ, সবাই খাকি পোশাক, আর্মস আর হেলমেট পরে আছে। কারা পাকিস্তানি আর কারা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা, আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। দেখলাম, আশপাশে প্রচুর লাশ পড়ে আছে।
দুই পক্ষই গুলি করা বন্ধ করি। শুরু হয় হাতাহাতি লড়াই। সেনাবাহিনীর ভাষায় এটাকে বলে ‘সিকিউবি’। শুরু হয় বেয়নেট চার্জ, বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত, লাথি, ঘুষি, ছুরি মারা ইত্যাদি। হঠাৎ করে একজন পাকিস্তানি হাবিলদার বুঝতে পারল আমি একজন সেনা অফিসার। মুহূর্তে সে আমাকে বেয়নেট দিয়ে মারার জন্য এগিয়ে আসে। সে ডানদিক থেকে আসছিল। কিন্তু আমি দেখতে পারিনি। আমার ওয়্যারলেস অপারেটর দেখতে পেয়ে আমাকে দুই হাতে ধাক্কা দেয়। ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। ঘটনাটা বলতে যতটা সময় নিচ্ছে, তত সময় সে সময় পাইনি। সবকিছু যেন কয়েক মুহূর্তেই ঘটে গেল। যাহোক, আমি মাটিতে বসা অবস্থায়ই পাকিস্তানি হাবিলদারের মাথায় গুলি চালাই। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন পাকিস্তানি অফিসার একটা বটগাছের পাশ থেকে বের হয়ে আমাকে গুলি করার জন্য বাম দিক থেকে স্টেনগানটা ডান দিকে ঘোরাতে থাকে। মাঝপথে তার স্টেনগানের গুলি শেষ হয়ে যায়। সুযোগটা লুফে নিলাম। সে আমার থেকে প্রায় ২০ ফুটের মধ্যে ছিল। আমি স্টেনগান দিয়ে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত গুলি করি। পুরো ম্যাগাজিনটা শেষ করে ফেলি। সে ওখানেই পড়ে গেল। যারা বেঁচে গেল, তারা পালানোর জন্য ধানখেত বরাবর দৌড়াতে থাকল। তাদের থামতে বললাম। কিন্তু তারা দৌড়াতেই থাকল। আমরা গুলি চালাই। পাঁচজন ওখানেই পড়ে যায়। ২৬ জন পাকিস্তানি সেনা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। খণ্ডযুদ্ধটা শেষ হতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো। তারপর আমরা আবার জায়গা নিজেদের দখলে নিয়ে নিই। এই যুদ্ধে আমাদের ১১ জন শহীদ হন। ছয়-সাতজন আহত হন। পাকিস্তানি সেনাদের ৮৮টি মৃতদেহ শনাক্ত করি। এর মধ্যে আমি যাকে পয়েন্ট রেঞ্জে গুলি করি, তাকেও পাই। তার পরিচয়পত্র খুঁজে জানতে পারলাম, সে মেজর গারোয়ার।
যুদ্ধের পুরো সময়টায় ছোট-বড় ২৬টি যুদ্ধ করি। তবে গৌরীপুর- কানাইঘাটের যুদ্ধে বীরত্বের জন্যই আমি বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হই।
 অনুলিখন: সুচিত্রা সরকার