ঢাকা মাঠের সেই 'দর্শকবিহীন' ম্যাচ

১৯৮৭ সালের ২৬ অক্টোবর আর্মি স্টেডিয়ামে সেই ‘দর্শকবিহীন’ আবাহনী-মোহামেডান লড়াই। ছবি: সংগৃহীত
১৯৮৭ সালের ২৬ অক্টোবর আর্মি স্টেডিয়ামে সেই ‘দর্শকবিহীন’ আবাহনী-মোহামেডান লড়াই। ছবি: সংগৃহীত

লা লিগায় গতরাতে বার্সেলোনা-লাস পালমাস ম্যাচটা দেখতে বসে অবাক হয়েছেন অনেকেই। দর্শক কোথায়? ন্যু ক্যাম্পে বার্সার ম্যাচে যেখানে দর্শক টইটুম্বুর থাকে, সেখানে গ্যালারি একেবারে ফাঁকা! নীরব-নিস্তব্ধ স্টেডিয়ামে শট নেওয়ার শব্দ, নিজেদের মধ্যে খেলোয়াড়দের কথাবার্তা সবই শোনা যাচ্ছিল স্পষ্ট। কেমন যেন একটা অদ্ভুত আবহ! কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার দাবি ও এ প্রশ্নে আয়োজিত গণভোটের কারণে স্পেন এখন উত্তাল। সেই উত্তাপের আঁচ এসে পড়ল ফুটবলেও। দাঙ্গা-হাঙ্গামার অস্থিরতার মধ্যে বার্সা তো প্রথমে এই ম্যাচটা খেলতেই চায়নি। কিন্তু স্প্যানিশ লিগ কর্তৃপক্ষের অনড় অবস্থানের মুখে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি খেলেছে তারা। তবে শর্ত ছিল খেলাটি হতে হবে ‘দর্শকবিহীন’ অবস্থায়। শেষ পর্যন্ত গ্যালারির খাঁ খাঁ অবস্থাতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে খেলাটি।
বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা কাল অনেকেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন। এই প্রজন্মের মনে থাকার কথা নয়, ৩০ বছর আগে দেশের ফুটবলের যখন রমরমা অবস্থা, দর্শক যখন উপচে পড়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) গ্যালারিতে, ফুটবল লিগের ম্যাচগুলোতে যখন প্রিয় দলের জয়-পরাজয় ছুঁয়ে যেত দর্শকদের, তখনই দেশের দুই সেরা ক্লাব আবাহনী ও মোহামেডানের একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল দর্শকবিহীন অবস্থায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ১৯৮৭ সালের ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সেই ‘দর্শকবিহীন’ ম্যাচটি ছিল লিগ-শিরোপা নির্ধারণী।
পৃথিবীর অনেক দেশেই বিভিন্ন সময় ‘দর্শকবিহীন’ খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দর্শক-হাঙ্গামার কারণে অনেক সময় স্টেডিয়াম খালি করে দিয়েও ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলে ‘দর্শকবিহীন’ ম্যাচ ওই একটাই। বনানীর সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত আর্মি স্টেডিয়ামে (সে সময় এরশাদ আর্মি স্টেডিয়াম; তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানের নামে ছিল স্টেডিয়ামটি) দেশের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী-মোহামেডান মুখোমুখি হয়েছিল ‘ভুতুড়ে’ এক লড়াইয়ে।
কী প্রেক্ষাপট ছিল সেই ম্যাচটির? আবাহনী-মোহামেডান লড়াই মানেই সে সময় দর্শক-হাঙ্গামার ব্যাপারটি চলে আসত। সত্তর-আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে আবাহনী-মোহামেডান লড়াই মানেই তো ছিল আকাশচুম্বী উত্তেজনা, আবেগে থরোথরো এক যুদ্ধ। ফুটবলীয় শ্রেষ্ঠত্ব, ক্লাব-মর্যাদার পাশাপাশি আরও অনেক কিছুই সামনে চলে আসত সে ম্যাচকে কেন্দ্র করে। ১৯৮৭ সালের ২৬ অক্টোবর আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচটি ‘দর্শকবিহীন’ অবস্থায় আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল এসব বিষয়কে মাথায় রেখেই।
১৯৮৭ সালের লিগ ছিল দারুণ জমজমাট। আবাহনী-মোহামেডান দুটি দলই ছিল তারকায় ঠাসা। প্রায় সমান শক্তির। আবাহনীতে সেবার খেলতে এসেছিলেন ইরাকের দুই বিশ্বকাপ তারকা সামির শাকির ও করিম মোহাম্মদ আলভী—১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতায় এই দুই ফুটবলার ছিলেন ঋদ্ধ। মোহামেডানও কম যায় না। ইরানের অত্যন্ত উঁচুমানের তিন ফুটবলার নালজেগার, মোর্তজা ও বোরহানজাদেহ ছাড়াও সাদা-কালো শিবিরে ছিলেন নাইজেরীয় ফুটবলার এমেকা ইজিউগো। কোচ ছিলেন ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ খেলা ইরানি গোলরক্ষক নাসের হেজাজি। হেজাজি অবশ্য সে মৌসুমে ছিলেন মোহামেডানের খেলোয়াড় কাম কোচ।
যা হোক, ১৯৮৭ সালে লিগের নির্ধারিত শেষ ম্যাচে মোহামেডান আবাহনীর মুখোমুখি হয়েছিল ২ পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে। আবাহনী শেষ ম্যাচে জিতলে বা ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে, কিন্তু মোহামেডান জিতলে আয়োজিত হবে একটি প্লে অফ ম্যাচ। ৮৭’র ৬ সেপ্টেম্বর লিগের শেষ ম্যাচে আবাহনীকে ৩-২ গোলে হারিয়ে পয়েন্ট সমান করে ফেলে মোহামেডান। ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্লে অফ ম্যাচটি। সে ম্যাচে নিয়ম করা হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের খেলা অমীমাংসিত থাকল অতিরিক্ত সময় কিংবা টাইব্রেকারে নিষ্পত্তি হবে ম্যাচের ভাগ্য। কিন্তু টান টান উত্তেজনার সেই ম্যাচটি ব্যাপক হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। মাঠে গোলযোগ হয় ব্যাপক। দুই দলের খেলোয়াড়েরা নিজেদের মধ্যে বারবার জড়িয়ে পড়তে থাকেন হাতাহাতিতে। সেই ম্যাচটি এমন বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে ৯০ মিনিট পার করে দেয় গোলশূন্য অবস্থায়। অতিরিক্ত সময়ের খেলা অনুষ্ঠানের আগের মুহূর্তেই ঘটে নজিরবিহীন এক ঘটনা। আবাহনী-মোহামেডানের খেলোয়াড়েরা নিজেদের বিভেদ, শত্রুতা ভুলে নিজেদেরই যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে খেলা শেষ করে দেন। গোটা দেশ প্রথমে এই ঘটনায় ধাক্কার মতো খেলেও পরে আনন্দের সঙ্গেই উপভোগ করে দুই ‘চিরশত্রুর’ সম্মিলন।
কিন্তু খেলোয়াড়দের এই সিদ্ধান্ত মানবে কেন বাফুফে? তারা সেটি মানেওনি। দুই দলের কয়েকজন খেলোয়াড়কে বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মোহামেডানের অধিনায়ক রনজিত সাহা ও আবাহনীর অধিনায়ক শেখ মোহাম্মদ আসলামকে এই ঘটনার জের ধরে বহিষ্কার করা হয় এক বছরের জন্য। আরও কয়েকজন খেলোয়াড়ের (আবাহনীর মোহাম্মদ মহসিন, মোস্তফা কামাল আর মোহামেডানের আবুল হোসেন ও ইলিয়াস হোসেন) ক্ষেত্রে এই মেয়াদ ছিল তিন মাস করে।
এর পরপরই বাফুফে প্লে অফটি নতুন করে আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করে। প্রায় দেড় মাস ধরে নানা বিতর্ক, বিবৃতি, পাল্টাবিবৃতির মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয় প্লে অফ ম্যাচের নতুন তারিখ—২৬ অক্টোবর। তবে ম্যাচটি নিয়েও জটিলতার সৃষ্টি হয়, আবাহনীর অনড় অবস্থানের কারণে। আবাহনী ম্যাচটি খেলতে অস্বীকৃতি জানায়।
আবাহনী সে ম্যাচটি খেলতে চাচ্ছিল নানা কারণেই। মাঝখানের বিরতি ছিল খুব বড় কারণ। আবাহনীর ইরাকি ফুটবলারদের চলে যাওয়া, নিষেধাজ্ঞার কারণে মূল গোলরক্ষক মহসিন, মধ্যমাঠের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় মোস্তফা কামাল ও অধিনায়ক আসলামকে না পাওয়া ছিল বড় কারণ। মোহামেডানেরও নিষেধাজ্ঞার সমস্যা থাকলেও সেটি তারা বড় করে দেখেনি। ম্যাচের আগে দিয়ে নাইজেরিয়া থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয় এমেকাকে।
অনড় অবস্থানের মধ্যেই আবাহনী ঘোষণা করে ম্যাচটি তারা খেলবে, তবে প্রতিবাদ হিসেবে ৯ জন নিয়ে নামবে তারা। বাফুফে সেটাও মানেনি। পরে অবশ্য নানামুখী চাপে আবাহনী ১১ জন নিয়েই সে ম্যাচটি খেলতে নেমেছিল। মোহামেডানের তুলনায় আবাহনী সে ম্যাচে ছিল বেশ দুর্বল।
আর্মি স্টেডিয়ামের খালি গ্যালারিতে সে ম্যাচে ২-০ গোলে জিতে লিগ শিরোপা নিজেদের করে নেয় মোহামেডান। সেটি ছিল মোহামেডানের টানা দ্বিতীয় লিগ শিরোপা। এর আগের মৌসুমে, ১৯৮৬ সালেও লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সাদা-কালোরা।
ম্যাচটি টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। দুপুর ৩টার দিকে শুরু হয়েছিল সেটি। একটু আগের প্রজন্মের কাছে ম্যাচটি কিন্তু অনন্য এক অনুভূতি, অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। গতরাতে বার্সা-লাস পালমাস ম্যাচে সে স্মৃতিই সামনে চলে এসেছিল আবারও। এখন প্রায় ফাঁকা স্টেডিয়ামে দিনের পর দিন লিগের খেলা অনুষ্ঠিত হলেও ৩০ বছর আগে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে ‘দর্শকবিহীন’ আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ যে অচিন্তনীয়ই ছিল।