দারিদ্র্যই চ্যাম্পিয়ন কিশোরীদের শক্তি

বাড়ির উঠানে খড় শুকাচ্ছে নাজমা। ছবি: প্রথম আলো
বাড়ির উঠানে খড় শুকাচ্ছে নাজমা। ছবি: প্রথম আলো

ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক লাগিয়ে চোখ পড়ল পাটখড়ির বেড়ায়। সন্ধ্যার আধো আলোয় হাসছে সদ্য লাগানো কিশোরী ফুটবলারদের বেশ কয়েকটা প্রথম আলোর পেপার কাটিং। ছবির একটি মেয়েকে দেখিয়ে চায়ের দোকানদারের দাবি, ‘আমার ছুডো বোইন।’ চার নম্বর জার্সিধারী মেয়েটির নাম নাজমা। অনূর্ধ্ব-১৫ সাফজয়ী দলের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার।

পরদিন সকালে সূর্যের আলোর তেজ বাড়ার সঙ্গেই পা রাখলাম কলসিন্দুর বাজারের পাশে নাজমার বাড়িতে। মেয়েটা রান্নার জন্য খড় রোদে দিচ্ছে। হ্যাঁ, দুই দিন আগে ভারতীয় স্ট্রাইকারদের ঠেকিয়ে দেওয়া মেয়েটা ব্যস্ত খড় শুকাতে। কোনো রকম বিব্রতবোধ ছাড়াই হাসিমুখে দিলেন ছবির জন্য পোজও। চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা বুঝি এমনই হয়—খেলার মাঠের বাইরে তাদের কাজের জায়গাটা যে রান্নাঘর থেকে শুরু করে গোয়ালঘর পর্যন্ত। দারিদ্র্যই তাদের শিখিয়েছে এত কিছু এবং এটাই তাদের অনুপ্রেরণার শক্তি।

বাড়ির উঠানে মারিয়া মান্দা ও তার মা। ছবি: প্রথম আলো
বাড়ির উঠানে মারিয়া মান্দা ও তার মা। ছবি: প্রথম আলো

তাই মুখে নেই কোনো কষ্টের ছাপ। কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম মুছে এক দমে গর্বের সঙ্গে বলে গেল গল্পটা,‌ ‘আমি যখন খেলা শুরু করি, তখন প্র্যাকটিস করে মাঠ থেকেই চলে যেতাম আব্বার চায়ের দোকানে। সেখানে আব্বাকে সাহায্য করে সন্ধ্যার পরে আসতাম বাড়ি। তারপর পড়তে বসতাম। এর মধ্যে কোনো খাওয়া হতো না। একবারে রাতে খেয়ে ঘুমাতাম। এখন তো অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। বাড়িতে এসে শুধু টুকটাক কাজ করতে হয়।’ বোঝাই যাচ্ছে, নিজেকে ভালো রাখার জন্য হলেও ভালো খেলার বিকল্প কিছু নেই মেয়েটির সামনে। চার ভাইবোনের মধ্যে নাজমাই ছোট। বাবা আবুল কালামের বয়স হয়েছে, তাই এখন বাড়িতেই থাকেন। আর গৃহিণী মায়ের কী বর্ণনাই-বা দেওয়া যাবে এত ছোট লেখায়!

অধিনায়ক মারিয়া মান্দার দারিদ্র্য জয়ের গল্পটা তো জানা থাকারই কথা। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন মারিয়া। তাই গর্ভাবস্থায় থাকা অবস্থাতেই তার মাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে হয়েছে। তা দিয়েই মারিয়াদের চার বোনের জুটত দুমুঠো ভাত। পরবর্তী সময়ে অনেক দিন তো মা ও বড় বোনের সঙ্গে গৃহপরিচারিকার কাজে হাত লাগাতে হয়েছে মারিয়াকেও। না হলে যে চুলোয় আগুন জ্বলত না। খালি পায়ে নদী পাড়ি দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথের শেষে সেই মারিয়ার বাড়ির উঠানে পা রেখেও প্রশ্ন জাগে, এই বাড়ি থেকেও কি চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক উঠে আসা সম্ভব! আসলে দারিদ্র্যই মারিয়াদের পরিশ্রমী হতে শিখিয়েছে। জয় করতে শিখিয়েছে সব বাধা।

তহুরাদের বাড়ি। ছবি: প্রথম আলো
তহুরাদের বাড়ি। ছবি: প্রথম আলো

মার্জিয়ার নামটি তো শুনে থাকার কথা। ডান প্রান্ত দিয়ে ঝড়ের বেড়ে আক্রমণে ওঠে এই উইঙ্গার। মাঠের বাইরে তার জীবনের গল্পটাও যেন এমনই এক ঝড়ের কেন্দ্রে লেখা হয়েছিল। পাঁচ ভাইবোনের বড় পরিবার। চার বোনের মধ্যে মার্জিয়াই ছোট। বাবা আবদুল মোতালেবকে পাওয়া গেল না বাড়িতে। কৃষিকাজের জন্য তিনি আছেন মাঠে। অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেই তাদের মুখে ওঠে দুমুঠো ভাত।

বাংলাদেশের গোলবার পাহারা দিয়েছে মাহমুদা, বল জালে ঢুকতে দেয়নি একটিবারও। সে মাহমুদার ঘর দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢোকে। বৃষ্টি দেখে তাই রোমাঞ্চিত হতে পারে না মাহমুদা, কবিতা লেখার কথাও মাথায় আসে না। এ যে শুধুই অসচ্ছলতার প্রতীক। সোনামাখা রোদ ঘরে ঢুকে বলে দেয়, এই ঘরের দেয়াল কতশত ফুটো। তবু দারিদ্র্যের মাঝে বেড়ে ওঠা মাহমুদারা বাংলাদেশকে রাখে অক্ষত।

টুকরো টুকরো করে জমালে পুরো বাংলাদেশ দলই হবে এমন দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে ঘেরা। কবে ঘুচবে তাদের অভাব? এ উত্তর হয়তো ওরাই দিতে পারবে। যে জয়রথ শুরু হয়েছে, অন্ধকার ঘরে আলো আসবেই। অভাব জয় করার জন্যই তো তারা মাঠে ছুটছে অদম্য গতিতে।