ইংলিশ লিগ মাতাচ্ছেন যে আরব

লেস্টারের বিপক্ষে জোড়া গোল করে ম্যাচের নায়ক মো সালাহ। ছবি: রয়টার্স
লেস্টারের বিপক্ষে জোড়া গোল করে ম্যাচের নায়ক মো সালাহ। ছবি: রয়টার্স

ভার্জিল ফন ডাইক মাঠে এসেছিলেন নতুন দলের খেলা দেখতে। ৩ মিনিটেই দেখলেন রক্ষণের সঙ্গী হিসেবে কাদের পাচ্ছেন। জঘন্য এক ভুলে গোল খেয়ে বসেছিল লিভারপুল। নিজেদের মাঠে লেস্টার সিটির বিপক্ষে এমন দুর্দশা কাটাতে আবারও এগিয়ে আসতে হলো মো সালাহকেই। দ্বিতীয়ার্ধে তাঁরই জোড়া গোলে লেস্টারকে ২-১ ব্যবধানে হারাল লিভারপুল। মো সালাহর জীবনের আরেকটা খুব স্বাভাবিক এক দিন!

৮ অক্টোবর রাতটা কোনো মিসরীয় মনে হয় না ভুলতে পারবেন। ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখছে দেশটি। কঙ্গোর বিপক্ষে ম্যাচের শেষ মুহূর্তে ১-০ গোলে এগিয়ে স্বাগতিক দল। জয় পেলেই প্রায় নিশ্চিত রাশিয়াযাত্রা। ৮৭ মিনিটে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! ডান প্রান্ত থেকে থিয়েভি বিফোমার ক্রস। তাতে কোনোমতে পা ছুঁয়ে দিলেন বৌকা মোতো। ১-১!

গ্যালারিতে দর্শকদের মাথায় হাত। কেঁদেও ফেললেন কয়েকজন। মধ্যমাঠের কাছাকাছি থাকা মো সালাহ করলেন দুটোই। প্রথমে মাথায় হাত দিলেন, তারপর হতাশায় শুয়েই পড়লেন মাঠে। কঙ্গোর উদ্‌যাপন শেষ হলো, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন সালাহও। কান্না সামলাতে সামলাতে প্রথমে একটা বুনো চিৎকার ছুড়লেন। এখনো যে সব শেষ হয়নি, এ বিশ্বাস নিজের মাঝে টানতেও যে ওটার দরকার ছিল। সতীর্থদের সঙ্গে দর্শককেও জাগানোর দায়িত্ব নিলেন। দুই হাত উঁচু করে দর্শকদের জানালেন, যদি গর্জন তুলতেই হয়, তবে এটাই সময়।

লিভারপুলের জার্সিতে সালাহ মানেই প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকের মুখে অসহায় দৃষ্টি। ছবি: রয়টার্স
লিভারপুলের জার্সিতে সালাহ মানেই প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকের মুখে অসহায় দৃষ্টি। ছবি: রয়টার্স

৯৩ মিনিটেই সেটি কাজে এল। ডি-বক্সে বোকার মতো এক ফাউল করে বসল কঙ্গো। পেনাল্টি পেয়েই জয়ের উল্লাসে মেতে উঠল পুরো মিসর। সে উন্মাদনা দেখে ভ্রম জাগতে পারত, ম্যাচ বুঝি শেষ হয়ে গেছে! কিন্তু শুধু একজন কোনো উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে গেলেন না। কারণ, তিনি ভালোমতোই জানতেন, স্পট কিকটা জায়গামতো না পাঠাতে পারলে একটি পুরো জাতির হতাশা তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসবে।

হতাশ করেননি সালাহ। ঠিকই বলটা জালে পাঠিয়েছিলেন সেদিন। সেদিন তাঁর জোড়া গোলেই বিশ্বকাপের টিকিট পেয়েছিল মিসর। সালাহর এমন পারফরম্যান্সে আর যে-ই অবাক হোন না কেন, লিভারপুল-সমর্থকেরা অবাক হননি। ‘অল রেড’দের জার্সিতে এ মৌসুমে পাঁচবার এ কাজ করেছেন। সর্বশেষ যেমনটা দেখা গেল শনিবার। লেস্টার সিটির বিপক্ষে নিজেদের মাঠে পিছিয়ে যাওয়া দলটি শেষ পর্যন্ত যে হাসিমুখে শুভ নববর্ষ বলতে পারছে, এর পেছনে সালাহর আরেক জোড়া গোলেরই অবদান।

এ মৌসুমেই দলবদলের ক্লাব রেকর্ড ভেঙে (সে রেকর্ড এখন ডাইকের দখলে) লিভারপুলে এসেছেন সালাহ। এ দলবদল নিয়ে কম কথা হয়নি। একদিকে সবাই বিস্মিত, এই দুর্দান্ত ফরোয়ার্ডকে এত কম মূল্যে কীভাবে নিয়ে এল লিভারপুল। আরেক দল সালাহকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলল। কারণ, প্রিমিয়ার লিগে তো এ প্রথম আসা নয় সালাহর। ভয়ংকর গতি, ড্রিবলিংয়ের জন্য মাত্র ২২ বছরেই চেলসিতে ডেকে আনা হয়েছিল তাকে। সেটি ছিল প্রথম কোনো মিসরীয়র চেলসিতে আসা। কিন্তু সে আসা সুখের হয়নি। দেড় মৌসুমে মাত্র তিন গোল করে ব্যর্থতার দায় নিয়ে ইতালিতে পাড়ি দিতে হয়েছিল তাঁকে। তাই প্রিমিয়ার লিগে তাঁর প্রত্যাবর্তন নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। থিয়েরি অরির মতো মানুষও সালাহকে ‘স্পেশাল ট্যালেন্ট’ মেনে নিয়েও আরও ‘অনেক দূর যেতে হবে’ বলে দিয়েছিলেন।

শুধু গোল করাতেই নয়, করানোতেও সালাহ দিন দিন পরিণত হয়ে উঠছেন। ছবি: রয়টার্স
শুধু গোল করাতেই নয়, করানোতেও সালাহ দিন দিন পরিণত হয়ে উঠছেন। ছবি: রয়টার্স

ছয় মাসেই অনেক দূর গিয়েছেন বলা যাচ্ছে না। তবে এ সময়েই ২৩ গোল করে কিছুটা হলেও জবাব দিয়েছেন মোহামেদ সালাহ ঘালি। লেস্টারের বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্সের পর সাবেক ইংলিশ ফরোয়ার্ড ইয়ান রাইট তো বিশাল এক তকমাই দিয়ে দিলেন, ‘আমি বলছি না আমি যার সঙ্গে তুলনা টানব তার মতো ভালো সালাহ। কিন্তু সে আমাকে মেসির কথা মনে করিয়ে দেয়। সে যেভাবে খেলে, তাতে একটা মেসি-মেসি ভাব আছে।’ এ অবশ্য নতুন নয়। রোমার হয়ে যখন সিরি ‘আ’ রাঙাচ্ছেন, তখনই তাঁকে ‘মিসরের মেসি’ ডাকত ইতালিয়ান গণমাধ্যম।

এই যে প্রশংসা-স্তুতি, অর্জন—এসব সবাই দেখছে। তাঁর ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পটা হয়তো সবার জানা নেই। কারণ সে গল্পে গ্ল্যামার নেই, আছে কঠোর পরিশ্রমের কথা। সাত বা আট বছর বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগ দেখতে গিয়ে ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলেন। হতে চেয়েছেন রোনালদো (নাজারিও), জিনেদিন জিদান কিংবা ফ্রান্সেসকো টট্টি। এঁদের মতোই মাঠ জাদু দেখাতে চাইতেন।

সে জাদু সবাইকে দেখানোর জন্য প্রথমে গ্রাম থেকে আধা ঘণ্টা দূরের এক ক্লাবে নাম লেখালেন। কদিন পরেই আরেকটি ক্লাব। এবার দেড় ঘণ্টার পথ। কিন্তু সালাহকে যে আকাশ ছুঁতে হবে। এরপর যোগ দিলেন কায়রোর আরব কন্ট্রাক্টরসে। সেখানে যেতেই লাগে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা। কখনো তিনটি, কখনো চার-পাঁচটি বাস বদলাতে হতো। সকাল সাতটায় বিদ্যালয়ে ঢুকে নয়টায় ক্লাবের উদ্দেশ্যে বের হও। সেখানে অনুশীলন শেষে ছয়টা নাগাদ বাসার উদ্দেশ্যে আবার ফিরতি যাত্রা। রাত ১০টা-সাড়ে ১০টা নাগাদ বাসায় ঢুকে খাওয়া ঘুম। পরদিন সকালে আবারও একই রুটিন। এভাবেই চলেছে তাঁর কৈশোর। কেন এই কষ্ট? সালাহই সবচেয়ে চমৎকার উত্তর দিয়ে দিয়েছেন, ‘আমার বয়স কম ছিল এবং আমার একটা স্বপ্ন ছিল।’

স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন সালাহ।