'যা বাবা, আমার স্বপ্নটা পূরণ করে আয়'

ব্রাদার্স ইউনিয়নের জার্সিতে বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বিশাল দাস। সংগৃহীত ছবি
ব্রাদার্স ইউনিয়নের জার্সিতে বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বিশাল দাস। সংগৃহীত ছবি

‘যা বাবা আমার স্বপ্নটা পূরণ করে আয়।’
আদেশের সুরে নিজের ইচ্ছেটা একমাত্র ছেলের ওপর অর্পণ করেছেন বাবুল দাস। বাবুলের স্বপ্ন ছিল, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলবেন। মোহামেডান ও বিজেএমসির মতো ক্লাবে খেললেও জাতীয় দলের স্বপ্নটা তাঁর অধরাই থেকে গিয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে ইতালিতে পাড়ি জমিয়েছেন, কিন্তু এই কষ্টটা তাঁকে এখনো পোড়ায়। তাই একমাত্র ছেলেকে ইতালি থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন, নিজের স্বপ্নটা পূরণ করার জন্য। ২৩ বছর বয়সী ছেলের নাম বিশাল দাস।

ঢাকার মাঠে নিয়মিত খেললেও ভাই খোকন দাসের মতো সে রকম খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি নারায়ণগঞ্জের বাবুল। জীবনের একপর্যায়ে পরিবার নিয়ে ২০০৭ সালে পাড়ি জমিয়েছেন ইতালিতে, বিশালের বয়স তখন ১২। ছেলেকে ফুটবলার বানানো যাঁর ইচ্ছে, তাঁর জন্য চারবারের বিশ্বকাপজয়ী দেশে পা রাখাটা তো সোনায় সোহাগাই। তাই দেরি না করে মাঠে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন ছেলেকে। ফুটবলার বাবার ছেলে ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের পোকা।

নারায়ণগঞ্জের কিশোর লিগগুলোতেও খেলেছেন নিয়মিত। ফলে দুই পায়ে ভালো কাজ দেখিয়ে পাদোয়া প্রদেশের স্থানীয় একাডেমির নজর কাড়তে সময় নেননি ছেলেটি। সাড়ে ষোলো বছর বয়সেই জায়গা করে নেন ইতালিয়ান চতুর্থ ডিভিশনের ক্লাব আভানথে। সেখানে সুবিধা না করতে পেরে দুই বছর পরে নাম লেখান একই বিভাগের ইউএস আর্চেলায়। বিশালের দাবি, তাঁর সুযোগ এসেছিল, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের প্রথম বিভাগে খেলার। কিন্তু বাবার স্বপ্নই তাঁকে পথ ঘুরিয়ে দিয়ে ২০১৭ সালে উঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বিমানে। আসার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বলে দিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলতে তোমাকে হবেই।’

অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দলের ক্যাম্পে বিশাল দাস। সংগৃহীত ছবি
অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দলের ক্যাম্পে বিশাল দাস। সংগৃহীত ছবি

বাবুল আগেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। তাই ঢাকায় পা রেখেই বিশাল সরাসরি যোগ দেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ক্যাম্পে। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার ফরোয়ার্ড বিশালকে পছন্দও করেন জাতীয় দলের কোচ অ্যান্ড্রু ওর্ড। কিন্তু আগেই এএফসিতে বাংলাদেশের খেলোয়াড় তালিকা পাঠিয়ে দেওয়ায়, সেবার আর সুযোগ হলো না। তবে বিশালকে মনে ধরেছিল বিধায় বাংলাদেশ কোচের উপদেশ ছিল, ‘তুমি বাংলাদেশে খেলো। তোমার সুযোগ আসবেই।’

কিন্তু এদিকে প্রিমিয়ার লিগের দলবদলও শেষ। দ্বিতীয় পর্বে নাম লেখান ব্রাদার্স ইউনিয়নে। কখনো উইঙ্গার বা কখনো ফুল ব্যাক পজিশনে খেলে আট ম্যাচে গোলও করেছেন একটি। কিন্তু বিশাল কারিশমা দেখিয়েছেন স্বাধীনতা কাপে। দুই ম্যাচে দুই গোল। গোলগুলোও দুর্দান্ত। টুর্নামেন্টে খেলেছেন আলাদা ঘরানার ফুটবলও। মাঠে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণটি হলো, শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় অ্যাটাকিং থার্ডে বল পায়ে ‘হোল্ড’ করে রাখতে পারেন। লাফাতেও পারেন অনেক উঁচুতে। জাতীয় দলে নম্বর নাইন হিসেবে এমন একটা স্ট্রাইকারই তো প্রয়োজন ছিল!

দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশ কোচ ওর্ড তখন ছুটিতে। তাই ওর্ডের জাতীয় দলে নতুনের ভিড়েও নাম ওঠেনি বিশালের। তাঁর আফসোসটা এখানেই, ‘আমি তখনই শুনেছিলাম কোচ ছুটিতে আছেন। তাই আমার মনও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভাবছিলাম, ভালো খেলার পরও তো কোচ দেখতে পারল না। যা-ই হোক আমি ধরে নিয়েছি আমাকে আরও উন্নতি করতে হবে। আরও ভালো খেলতে হবে।’

ইতিমধ্যে তল্পিতল্পা গুছিয়ে ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিশাল। তবে এর আগে নতুন মৌসুমের ক্লাব ঠিক করেই ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার ইচ্ছা তাঁর। কয়েকটি বড় ক্লাবের প্রস্তাব পেয়েছেন বলেও জানান। ফেরার সময় তাঁর বুকে কষ্ট বোঝা বাড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু হাল না ছেড়ে এই কষ্টকেই জানালেন চ্যালেঞ্জ, ‘জাতীয় দলের জার্সিতে খেলতে আমাকে হবেই।’ বাবার স্বপ্নটাই এখন ছেলের স্বপ্ন।