সেদিন তুমি কোথায় ছিলে?

সেই বিখ্যাত স্টান্ট। ফাইল ছবি
সেই বিখ্যাত স্টান্ট। ফাইল ছবি

• ৯৯.৯৪ গড় নিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ব্র্যাডম্যান।
• টেস্ট ও প্রথম শ্রেণিতে তাঁর রেকর্ড ছোঁয়ার সম্ভাবনাও কেউ কখনো জাগাতে পারেননি।
• ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিয়েছেন সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।

আসলেই, কোথায় ছিলাম?

ফেব্রুয়ারি মাস যেহেতু, নিঃসন্দেহে স্কুলে তখনো ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলছিল। এর মানেই টিফিনের ঘণ্টা বাজার আগেই বাকি ক্লাসগুলো বাতিল। স্কুলের সংগীতজ্ঞরা যখন দুপুরের অনুশীলন নিয়ে ব্যস্ত, আমরা তখন পালাতে ব্যস্ত।

অদূরের ওই গর্জন তোলা সমুদ্র আমাদের ডাকছে তখন। ঝাউবনে তখন সুর জেগেছে, সে ছন্দে নাচতে ভদ্র ছেলের মুখোশপরা ছেলেপেলের দল ছুটছে সেদিকে। সাগরের জলে নামতে হবে, তপ্ত বালুতে পায়ে ফোসকা পড়ার ভয় নিয়েও ফুটবল খেলতে হবে। আর যদি কোনো জেলের দয়া হয়, তবে নৌকায় চড়ে খুব ‘জলদস্যু’ ‘জলদস্যু’ ভাবও তোলা হবে। আর যদি কোনো কারণে ওদিকমুখী না হওয়া যায়, তাহলে তো মাঠে ব্যাট-বল হাতে নেমে পড়া আছেই।

পড়ন্ত বেলায়ও উজ্জ্বল ডন। ফাইল ছবি
পড়ন্ত বেলায়ও উজ্জ্বল ডন। ফাইল ছবি

তখনো ইন্টারনেট মানেই সাইবার ক্যাফে। বন্ধুবান্ধবের অধিকাংশই ওই মুখোশপরা ভদ্র ছেলে হওয়ায় কারও বাসার টিভিতে কেবল লাইনও ছিল না। বিটিভির সংবাদও দুপুর-বিকেলে দেখার ফুসরত ছিল না। তাই এই অর্বাচীনের জানার সুযোগ ছিল না, ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিলে যার রেকর্ড ভাঙার দুঃসাহস ঘটানোর স্বপ্ন দেখে, সেই মানুষটি সেদিনই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। জীবনে যে লোকটি কখনো নার্ভাস নাইনটিজ কী জিনিস জানতেন না, তিনিই কিনা ৯২-তে থেমে গেলেন!

সে দিনটাও ছিল আজকের মতোই আরেকটি দিন, আরেকটি রোববার। আজ থেকে ১৭ বছর আগে, এই ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনটাতেই আমাদের বিদায় জানিয়েছেন স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান, যাঁকে সবাই ডন ব্র্যাডম্যান বলেই চেনে কিংবা এককথায় ‘দ্য ডন’। যাঁর মৃত্যু নিয়েই অস্ট্রেলিয়ান সাবেক রাগবি অধিনায়ক জন ইলস বলেছিলেন, ‘সবাই আজীবন মনে রাখবে, ডন ব্র্যাডম্যান যেদিন মারা গেলেন, তখন সে কোথায় ছিল।’

মনে রাখারই কথা, ডনের মৃত্যুদিন বলে কথা! এমন লোকের কথা বলছি আমরা, যাঁর কথা জীবদ্দশাতেই সবাইকে প্রতিটি ক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে একবার ভাবতে হতো। নেলসন ম্যান্ডেলার গল্পটা নিশ্চয় মনে আছে? অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ফ্রেজার দেখা করতে গিয়েছিলেন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। সময়টা ১৯৮৬, তখনো বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন এই অবিসংবাদী নেতা। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন ম্যান্ডেলার প্রথম প্রশ্ন, ‘ফ্রেজার, বলো তো, ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান কি এখনো বেঁচে আছে?’

যখন ক্যারিয়ারের চূড়ায় ছিলেন। ফাইল ছবি
যখন ক্যারিয়ারের চূড়ায় ছিলেন। ফাইল ছবি

ম্যান্ডেলার এমন প্রশ্নে অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন কিন্তু কোনো অস্ট্রেলিয়ান নন। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য একজন ম্যান্ডেলা যেমন, ব্র্যাডম্যান তো অস্ট্রেলিয়ার জন্য ঠিক তা-ই। আকারে যতই বড় হোক না কেন, এ দেশটি ভয়ংকর দরিদ্র ছিল একটি ব্যাপারে, এদের কোনো নায়ক ছিল না। ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে এমন কোনো যুদ্ধ হয়নি, আব্রাহাম লিঙ্কন কিংবা ম্যান্ডেলার মতো কোনো নেতারও জন্ম হয়নি এ দেশে। সে দেশটা নায়ক খুঁজে পেল ক্রিকেট খেলায়! ত্রিশের দশকে যখন ভয়ংকর মহামন্দা চলছে, ঠিক তখন আবির্ভাব হয়েছে ব্র্যাডম্যানের। তাঁর ব্যাটের রানবন্যা শুধু ক্রিকেট দলকে সাহস দেয়নি, দেশকেও জাগিয়ে তুলেছে। মহামন্দার সেই সময়েও অস্ট্রেলিয়ার দেশজ উৎপাদন বেড়েছে, কারণ মাত্র ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার একটা লোক ক্রিকেট মাঠে ওভাবে দাপিয়ে খেলছেন বলেই।

শুধু অস্ট্রেলিয়ানরাই তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল, এটা ভাবলে ভুল হবে। ১৯৩৪ সালে দুর্দান্ত এক অ্যাশেজের পর ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়েন ব্র্যাডম্যান। জীবন-মরণের সন্নিকটে আছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারকে বিদায় জানানোর ভয়ংকর এক শোক সংবাদ প্রস্তুত করে রেখেছিল প্রতিটি সংবাদমাধ্যম। তাঁর রক্ত লাগবে এ সংবাদ প্রকাশের পর অবশ্য লন্ডনের হাসপাতালটিকে বাকি সময়টা স্বেচ্ছা রক্তদান করতে আগ্রহীদের সামলাতে পার করতে হয়েছে। স্বয়ং রাজা ষষ্ঠ জর্জ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ব্র্যাডম্যানের প্রতিটি মুহূর্তের খবর তাঁকে যেন সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয়।

টেস্টে শেষবারের মতো মাঠে নামলেন ব্র্যাডম্যান। ফাইল ছবি
টেস্টে শেষবারের মতো মাঠে নামলেন ব্র্যাডম্যান। ফাইল ছবি

তবে চার ঘণ্টা লম্বা এক অস্ত্রোপচার সে যাত্রা ক্রিকেটকে ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ব্র্যাডম্যানও নিজেকে তুলে নিয়েছেন হিমালয়তুল্য উচ্চতায়। সে কেমন উচ্চতা বোঝাতে ক্রিশ্চিয়ান রিনিউয়াল ম্যাগাজিনের ওই বাক্যটাই তো যথেষ্ট, ‘সব মানুষ যে সমান হতে পারে না এর জীবন্ত প্রমাণ হলেন ব্র্যাডম্যান।’ এ কারণেই অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত ইংলিশরা তাঁর অবসরের সিদ্ধান্তের পর একটু হলেও স্বস্তি পেয়েছে। বিল এডরিচ তো বলেই ফেলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ডের সবাই এখন ভাবছে, অ্যাশেজে আবার একটু সমানে সমান খেলা দেখা যাবে।’ আবার স্যার উইলিয়াম নরম্যান বিরকেটের মতো ব্রিটিশ ব্যক্তিত্বও বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘কখনো কোনো মানুষের মুখ থেকে এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু শুনিনি।’ ব্র্যাডম্যানের ব্যক্তিত্বের মোহ ছিল এ পর্যায়ের!

জীবনের চেয়েও বড় এমন একজনের মৃত্যুর খবরে যে তোলপাড় হবে, এ আর এমন কী! কিংবা সে দিনটায় কে কোথায় ছিল, এ কথাটা মনে রাখবে, এতেও বিস্ময়ের কী আছে? এ যে ডন ব্র্যাডম্যানের মৃত্যুদিন, দেড় শ বছরের ইতিহাসে যার তুলনা খুঁজে পায়নি ক্রিকেট।

ভালো থাকুন ডন, স্বর্গের মাঠেও দাপিয়ে রান উৎসবে মাতুন। ৯৯.৯৪ গড়ে থেমে নিজেকে মানুষ প্রমাণ করার দায় তো অন্তত পরকালে নেই আপনার!