সেঞ্চুরি কিংবা ৭ উইকেট নিলেই গাছ লাগানো হয় যেখানে

নয়নাভিরাম জ্যাক ক্যালিস ওভাল। ছবি: টুইটার
নয়নাভিরাম জ্যাক ক্যালিস ওভাল। ছবি: টুইটার

সেঞ্চুরি যেকোনো ব্যাটসম্যানেরই আরাধ্য। তিন অঙ্কের এই সংখ্যায় পৌঁছে সবাই ভেসে যায় প্রশংসায়। জোটে নানা রকম উপহারও। কিন্তু কখনো শুনেছেন, সেঞ্চুরি করলে গাছের নামকরণ হয় সেই ব্যাটসম্যানের নামে!

দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘টেবল মাউন্টেন’-এর কোলঘেঁষা নিউল্যান্ডস স্টেডিয়াম এমনিতেই নয়নাভিরাম জায়গা। সেখান থেকে বেশি নয়, পাঁচ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত আরও একটি মাঠ আছে—জ্যাক ক্যালিস ওভাল। এটা ওয়েনবার্গ বয়েজ হাইস্কুলের মাঠ, দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস এই স্কুলেই পড়তেন। তাঁর নামেই সেই মাঠের নামকরণ।

তো, এই জ্যাক ক্যালিস ওভালের চারপাশটা ভীষণ সবুজ। নানা রকম গাছের সমাহার। কাওয়াজুলু-নাটালে হিলটন কলেজের দেখাদেখি ১৯৯৪ সালে ওয়েনবার্গ স্কুলের প্রধান শিক্ষক কিথ রিচার্ডসন চমকপ্রদ এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মাঠে যাঁরা সেঞ্চুরি পাবেন, তাঁদের নামে মাঠের চারপাশে গাছ লাগানো হবে! বোলাররা বাদ যাবেন কেন? সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এক ইনিংসে ৭ উইকেট পাওয়া বোলারের নামেও গাছের নামকরণ করা হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টি-টোয়েন্টি আর বিপিএল খেলা ওপেনার রিচার্ড লেভির নামে এই মাঠে ১২টি গাছ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার ডমিনিক ওয়েনবার্গ স্কুলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ক্রিকেটার ডমিনিক টেলোর নামে রয়েছে ১৩টি গাছ। ক্যালিস সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার মাত্র তিনটি গাছের মালিক। ১৯৯৩ সালে ক্যালিসের নামে (স্কুল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর) গাছ তিনটি লাগানো হয়।

যার নামে মাঠের নামকরণ, সেই ক্যালিসের নামে স্মারক। ছবি: টুইটার
যার নামে মাঠের নামকরণ, সেই ক্যালিসের নামে স্মারক। ছবি: টুইটার

ওয়েনবার্গ স্কুলে ক্যালিসেরই সাবেক শিক্ষক এরিক লেফসন ক্রিকইনফোকে জানান, নব্বইয়ের দশকে খুব বেশি গাছ লাগানো হয়নি। কিন্তু নতুন শতাব্দীর শুরু থেকেই স্কুলের খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স দারুণ। আর তাই মাঠের আশপাশে ৬০টি গাছ লাগানো সম্ভব হয়েছে। মাঠটির এক কোণে একটি বেঞ্চ আছে যেখানে ক্যালিসের একটি ইনিংসের কথা খোদাই করে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। ২০১০ সালে সেঞ্চুরিয়নে ভারতের বিপক্ষে ২০১ রানে অপরাজিত ছিলেন ক্যালিস—সেই ইনিংসেরই স্মৃতিই ধরে রেখেছে বেঞ্চটি।

সাধারণত কোনো খেলোয়াড়ের সাফল্যের স্মারক হিসেবে গাছ লাগানো হয়। সেই গাছের নিচে কপারের স্মারকে খেলোয়াড়টির অর্জনের বিবরণী খোদাই করা থাকে। এতে কোন গাছ কোন খেলোয়াড়ের অর্জনের স্মারকচিহ্ন তা বোঝা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সমস্যা হলো, কপারের এই স্মারক কে বা কারা চুরি করছে! ওয়েনবার্গ স্কুলের ক্রিকেট কোচ অস্কার নাউহাউস জানালেন, ‘আমরা মনে করছি, স্মারকগুলো চুরির পর বাজারে বিক্রি করে ক্রিস্টাল মেথ (মাদক) কেনা হচ্ছে। কেপটাউনে এটা বেশ বড় সমস্যা।’

স্মারকগুলো চুরি হওয়ায় কোন গাছ কোন খেলোয়াড়ের নামে তা বোঝা বেশ দুষ্কর। তবে ওয়েনবার্গ স্কুল কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। স্মারকবিহীন গাছগুলো চিহ্নিত করে কয়েক মাসের মধ্যেই তা পুনঃস্থাপন করা হবে।

রিচার্ড লেভির নামে লাগানো গাছ। পরে অবশ্য কেটে ফেলা হয়। ছবি: ক্রিকইনফো
রিচার্ড লেভির নামে লাগানো গাছ। পরে অবশ্য কেটে ফেলা হয়। ছবি: ক্রিকইনফো

ক্রিকেটারদের অর্জনে গাছ লাগানোর এ প্রথা দক্ষিণ আফ্রিকার স্কুলগুলোতে ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে, সে ব্যাপারে মতভেদ আছে। দেশটির কিংবদন্তি ক্রিকেটার মাইক প্রোক্টর তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, তাঁর স্কুলজীবন শুরুর আগেই কাওয়াজুলু-নাটালের হাইবুরি স্কুলে প্রথাটির শুরু—সেটা পঞ্চাশ দশকের শুরুতে। প্রোক্টরের স্কুলজীবন কেটেছে হিলটন কলেজে, ধারণা করা হয় হাইবুরি থেকে প্রথাটা ধার করেছে হিলটন।

দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক খ্যাতনামা ক্রিকেটারের কপালেই কিন্তু এই গাছ জোটেনি। বর্তমান দলটির তারকা পেসার কাগিসো রাবাদার কথাই ধরুন। জোহানেসবার্গের সেন্ট স্টিথিয়ানস কলেজে থাকতে রাবাদা এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩ কিংবা ৪ উইকেট পেয়েছেন। ওই স্কুলে গাছ লাগাতে চাইলে অন্তত ৫ উইকেট পেতে হয়। এরপর ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬ উইকেট নেওয়ার পর রাবাদা সুদূর আরব আমিরাত থেকে দেশে ফোন করেন নিজের ক্রিকেটগুরু উইম জ্যানসেনের কাছে। মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা গুরুর কাছে শিষ্যের দাবি, ৬ উইকেট নিয়েছি তাই গাছ চাই!

স্কুলমাঠের অর্জন নয় বলে রাবাদার দাবি কেউ রাখেনি। সেই জেদের বশবর্তী হয়েই হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের শিকড় বিস্তৃত করে চলছেন এ পেসার। কে জানে, একদিন হয়তো রাবাদার নামে গাছ লাগানো না হোক, বেঞ্চ বসানো হবে!

ক্যালিসের সেই ২০১ রানের ইনিংসের স্মারক বেঞ্চ। ছবি: ক্রিকইনফো
ক্যালিসের সেই ২০১ রানের ইনিংসের স্মারক বেঞ্চ। ছবি: ক্রিকইনফো