ব্যর্থতার ভয় নেই, জায়গা দখলের ক্ষুধা নেই

বিমর্ষ দলনেতা! ম্যাচ শেষে সাকিব আল হাসান। ছবি: ফেসবুক
বিমর্ষ দলনেতা! ম্যাচ শেষে সাকিব আল হাসান। ছবি: ফেসবুক
>সমস্যাটা কোথায়? দলে ঢোকার তীব্র প্রতিযোগিতার অভাব! ব্যর্থ হলে দলে জায়গা হারানোর ভয় নেই। কারও জায়গা দখল করার জন্য বাইরে থাকাদের তীব্র ক্ষুধা নেই

বুধবারের দুটি ছবি দুই ধরনের। আফগানিস্তানের খেলোয়াড়েরা স্থানীয় অভিমন্যু ক্রিকেট একাডেমিতে নিবিড় অনুশীলনে যখন ব্যস্ত, বাংলাদেশি শিবির তখন মুহ্যমান। মনমরা অবস্থা কিছুতেই কাটছে না। মুষড়ে পড়া দলে হতাশার সঙ্গে ক্লান্তিও ছায়া ফেলে। বাংলাদেশ শিবিরে সেই ছবি। অনুশীলনেও জোর নেই। মনে ঘুরপাক খাচ্ছে মঙ্গলবার রাতে তাদের ইনিংসের অভিশপ্ত ১৬তম ওভার।

‘গোটা দলটাই খুব মুষড়ে পড়েছে। দ্বিতীয় ম্যাচটা এভাবে হারতে হবে কেউ ভাবতে পারেনি। বাংলাদেশ শিবির যেন নিঝুমপুরী।’ শহরের এক প্রান্তে চকরাতা রোডের ধারে রেজেন্টা এল পি বিলাস হোটেলের ক্রিকেট অনুরাগী এক কর্মী এভাবেই বর্ণনা দিলেন বাংলাদেশি শিবিরের। বৃহস্পতিবারের শেষ ম্যাচ এখন স্রেফ নিয়মরক্ষা মাত্র। অথচ স্থানীয় এক ক্রিকেট একাডেমিতে আফগানরা গা ঘামাচ্ছে। কারণ, তাদের কাছে পাখির চোখ এখন বেঙ্গালুরুর টেস্টে। বাংলাদেশকে পর্যুদস্ত করার পর ভারতকে তারা দেখাতে চায়, টেস্ট ক্রিকেটেও তাদের এলেম আছে।

বাংলাদেশের অবস্থাটা এই মুহূর্তে সেই অভাগার মতো, যার দৃষ্টিতে সাগর শুকিয়ে যায়। দ্বিতীয় ম্যাচটি তারা মনেপ্রাণে জিততে চেয়েছিল। সে জন্য অনেক আলোচনার পর দলের কৌশলও ঠিক করা হয়। সাকিব নিজে তিন নম্বরে না নেমে লোয়ার অর্ডারে নামবেন। সঙ্গে রাখা হবে আর এক বাঁ হাতি সৌম্যকে। এই কৌশলের উদ্দেশ্য, শেষের দিকে বাঁ হাতিদের দিয়ে রশিদের মোকাবিলা যাতে ভালোভাবে করা যায়। কৌশলটা খাটছিলও।

অভিজ্ঞ তামিম দায়িত্ব নিয়ে খেলছিলেন। মুশফিকের সঙ্গে জুটিটাও জমে উঠছিল। ১৫তম ওভারে ৪ উইকেটে ১০১। রশিদ দুই ওভার হাত ঘুরিয়ে কোনো উইকেট পাননি। তাঁর বাকি আর দুটি মাত্র ওভার। সেই দুটি ঠেকিয়ে বাংলাদেশের নজর ১৫০-১৬০–এর দিকে, এই উইকেটে যা অবশ্যই বেশ ভালো রান।

অথচ তৃতীয় ওভারেই ভয়ংকর হয়ে উঠলেন রশিদ। ১০১-৪ থেকে স্কোর বোর্ড বদলে হলো ১০৩-৭। ম্যাজিকের মতো সাকিব, তামিম ও মোসাদ্দেক নেই!
বাংলাদেশের অভাব অনেকগুলো। প্রথম অভাব ভালো লেগ স্পিনারের। সাব্বির লেগ স্পিনার। কিন্তু তাঁর গুগলি ছোবল মারে না। টি-টোয়েন্টি এমনিতেই বোলারদের বধ্যভূমি। সেখানে সমীহ আদায় করতে গেলে প্রয়োজন লেগ স্পিনে ‘গুগলি ও টপ স্পিনের’ মতো বৈচিত্র্য।

আফগানদের হয়ে রশিদ এই জায়গাতেই বাজিমাত করে দিচ্ছেন। আইপিএলেও এভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিলেন ভারতের কুলদীপ যাদব, যজুবেন্দ্র চাহাল, ইশ সোধি, মায়াঙ্ক মার্কন্ডের মতো লেগ স্পিনাররা। রনি ও রুবেল মাঝে মাঝে আফগানদের বেগ দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু লাইন ও লেংথের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি। টি-টোয়েন্টিতে ইয়র্কার, স্লোয়ার ডেলিভারির কদর খুব। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পিছিয়ে।

দ্বিতীয় অভাব প্রতিভার। খুব বেশি ঝাড়াই-বাছাইয়ের সুযোগ এই টিমে আদৌ আছে কি না, সে প্রশ্ন ক্রমেই উঠে আসছে। কারণ, দেখা যাচ্ছে ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’-এর বাইরে কিছু হচ্ছে না। প্রতিভা তুলে আনতে হলে ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলো জোরদার করা আবশ্যিক। বিসিবিকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় দলে কেন পুরো সময়ের জন্য উপযুক্ত একজন কোচ থাকবেন না, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেটাও বিস্ময়ের।

হাথুরুসিংহের পর এখনো এই পদটা কেন খালি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সবচেয়ে বড় কথা, বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে এই ভয়টাই নেই যে আমি ব্যর্থ হলে আমার জায়গা ভরাট করার জন্য দু-চারজন উইংসের আড়ালে অপেক্ষা করছে। এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য, নবীনদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার খিদের অভাব।

আফগানিস্তানের তিন স্পিনার তিন ধরনের বৈচিত্র্যে পূর্ণ। মোহাম্মদ নবী অফ স্পিনার ও অলরাউন্ডার। ৩৩ বছর বয়স। আফগানিস্তানের হয়ে এক দিনের ক্রিকেটে তিনিই প্রথম ১০০-র বেশি উইকেট পেয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে আলোচিত রশিদ ও মুজিব। মুজিবুর রহমানের বৈশিষ্ট্য হলো লেগ স্পিনার হয়েও একই লেংথ ও লাইন ধরে রাখতে পারেন। এ ধরনের বোলাররা উইকেট পান ব্যাটসম্যানদের বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়ে। ষাটের দশকে ভারতে বাপু নাদকার্নি ছিলেন ঠিক এই ধাঁচের বাঁ হাতি অফ স্পিনার। উইকেট না পেলেও একটার পর একটা মেডেন পেতেন।

বাংলাদেশ রশিদকে বেশি সমীহ করছে। অথচ রানও দরকার। নবী ও মুজিবুরকে তাই মারতে গিয়ে তারা উইকেট খোয়াচ্ছে। তিন আফগান স্পিনার দুটি খেলার প্রথমটায় ১১ ওভারে ৫৪ রান দিয়ে ৬টি ও দ্বিতীয়টিতে ১২ ওভারে ৪৬ রান দিয়ে ৬টি উইকেট তুলে নিয়েছেন। অথচ বিশ ওভারের খেলা বোলারদের বধ্যভূমি! বাংলাদেশের প্রয়োজন এমনই সমীহ জাগানো দু-একজন বোলার।