ম্যারাডোনা-জিদানরা যখন বিশ্বকাপের খলনায়কও!

২০টি বিশ্বকাপ দেখেছে ফুটবল। এত এত বিশ্বকাপের কতশত স্মৃতি! কিছু ভালো, কিছু খারাপ, কিছু একেবারে জঘন্য! ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ অনেক নায়কের দেখা যেমন পেয়েছে, তেমনি কম দেখেনি খলনায়কদেরও। কখনো জঘন্য ফাউল, কখনো রেফারির চোখ ফাঁকি দেওয়া কোনো অন্যায় বা ম্যাচের আগে-পরের ঘটনা মিলিয়ে কতজনই উঠে গেছেন ফুটবলের ‘ব্যাড বুকে।’

ম্যারাডোনা, আর্জেন্টিনা
হ্যান্ড অব গড। বিশ্বকাপের খলনায়কীয় কাণ্ডকীর্তির তালিকা এটি ছাড়া পূর্ণ হয় নাকি! আর কাউকে লাগবে না, শুধু ইংল্যান্ডের সাবেক গোলকিপার পিটার শিলটনকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। বাকি বিশ্বের কাছে ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবদন্তি হতে পারেন, অনেকের কাছে হতে পারেন সর্বকালের সেরাও। কিন্তু শিলটন ও আরও শতসহস্র ইংলিশের কাছে ম্যারাডোনার পরিচয় একটাই-প্রতারক! ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের একাদশের অর্ধেকেরও বেশি খেলোয়াড়কে কাটিয়ে করা ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোলটি তো তর্ক সাপেক্ষে বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সেরা। আর প্রথমটির কারণেই তাঁর ঠাঁই এই তালিকায়। নিজের চেয়ে আট ইঞ্চি লম্বা ইংল্যান্ড গোলকিপার শিলটনকে টপকে বল জালে পাঠাতে যে হাতটাও অব্যবহৃত রাখেননি আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি!

সুয়ারেজ, উরুগুয়ে
এভাবে বলা যায়, কোথায় থামতে হবে, সে হিসাব উরুগুয়ের অতি-আবেগী স্ট্রাইকারের থাকে না। দুটি বিশ্বকাপ খেলেছেন, দুটিতেই কিছু না কিছু করে আলোচনায়-সমালোচনায় সুয়ারেজ। ব্রাজিল বিশ্বকাপের নাটকীয় ঘটনাটা তো এই সেদিনের ঘটনাই মনে হচ্ছে! ফ্রি-কিক থেকে ভেসে আসা বলের দখলে নেমে ইতালির ডিফেন্ডার জর্জো কিয়েলিনির ঘাড়ে কামড়ে দিয়েছিলেন সুয়ারেজ। তাঁর ক্যারিয়ারে তখন পর্যন্ত, সৌভাগ্যবশত এখন পর্যন্তও, প্রতিপক্ষকে কামড়ানোর তৃতীয় ঘটনা। ওই ঘটনায় চার মাস ফুটবল থেকেই নিষিদ্ধ ছিলেন সুয়ারেজ!
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে তাঁর কাণ্ডটাই বা কে ভুলবে! কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানার একটা শট জালে ঢুকতে দেখে গোললাইনে দাঁড়ানো সুয়ারেজ বনে গিয়েছিলেন ‘গোলকিপার!’ হাত দিয়ে বল ঠেকিয়ে লাল কার্ড দেখেন, তাতে পেনাল্টি পেয়েও অবশ্য কাজে লাগাতে পারেনি ঘানা। তা ঘানা আর আফ্রিকার আরও অন্য দেশের অনেক মানুষের কাছে সুয়ারেজ খলনায়ক হতে পারেন, ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়ায় তো উরুগুয়েতে তিনি নায়কই!

ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, হল্যান্ড
জার্মানির স্ট্রাইকার রুডি ফোলারের সঙ্গে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা ছিল কি না, কে জানে! না হলে নিশ্চিত ফোলারের চুলের ধরনটা পছন্দ হয়নি ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের। না হলে ওভাবে ফোলারের চুলেই বারবার থুতু ফেলেছিলেন কেন? ২১ মিনিটে জার্মান স্ট্রাইকার রুডি ফোলারকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেছিলেন। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় ফোলারের মাথায় থুতু মেরে যান। সেটি নিয়ে দুজনের কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে রেফারি হলুদ কার্ড দেখান ফোলারকেও। কিন্তু সেখানেই শেষ হলে তো! পরের মিনিটেই হল্যান্ডের বক্সে গোলকিপার হ্যানস-ভন ব্রুকেলেনকে ফাউল করেন ফোলার, তাঁকে আবার উল্টো ফাউল করেন রাইকার্ড। রেফারি দুজনকেই দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখিয়ে বের করে দেন। তা আর হারানোর কিছু নেই দেখেই কি না, যাওয়ার বেলায় আবার ফোলারের চুলে থুতু মারেন রাইকার্ড!

শুমাখার, পশ্চিম জার্মানি
একমুহূর্তে বলতে গেলে বিশ্বের সবার ঘৃণা ‘অর্জন’ করে নিতে কী লাগে? হারাল্ড শুমাখার সেটি ভালো বলতে পারবেন। ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তেমন ঘৃণিত কাজই করেছিলেন জার্মানির গোলকিপার। প্লাতিনির থ্রু বল ধরে শেষ ডিফেন্ডারকেও পেরিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রান্স ডিফেন্ডার ব্যাটিস্টন। এরপরই তাঁর চোখে-মুখে অন্ধকার দেখার জোগাড়! গোলপোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসা শুমাখার এমনই জঘন্য ট্যাকল করেছেন ব্যাটিস্টনকে। তাতে ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডারের কয়েকটি দাঁত নেই, মেরুদণ্ডের হাড়ও ভেঙেছে। ফাউলটা দেখে মনেই হয়নি, বল ধরার চেষ্টা একটা মুহূর্তের জন্যও শুমাখারের ছিল।

মাতেরাজ্জি, ইতালি/জিদান, ফ্রান্স
১২ বছর আগের বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই ঢুসের কথাই যে বলা হচ্ছে, তা তো বোঝাই যায়। তাতে লাল কার্ড দেখে হয়তো ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিশ্বকাপটাও জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন সেদিন জিদান। কিন্তু অপরাধটা আসলে কার ছিল? ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তির নাকি ইতালি ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জির? সেই বিশ্বকাপ ফাইনালের বছরখানেক পরই মাতেরাজ্জি স্বীকার করেছিলেন, জিদানকে রাগাতেই তিনি ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ডারের বোনকে নিয়ে জঘন্য মন্তব্য করেছিলেন। এতটাই যে, কোটি কোটি মানুষের চোখ যে মঞ্চে, সেই বিশ্বকাপ ফাইনালও তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল জিদানের কাছে! ১১০ মিনিটে ঢুসটা মেরে লাল
কার্ড দেখেন জিজু, ফ্রান্সের বিশ্বকাপস্বপ্নও হয়তো সেখানেই শেষ। টাইব্রেকারে জিতে শিরোপা ইতালির।
এর বাইরেও ঘটনার তো আর কমতি নেই। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কথাই কীভাবে ভুলবেন? ২০০৬ বিশ্বকাপে সে সময়ের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-সতীর্থ ও ইংল্যান্ড স্ট্রাইকার ওয়েইন রুনিকে যেভাবে লাল কার্ড দেখাতে রেফারিকে বাধ্য করেছিলেন পর্তুগাল ফরোয়ার্ড, পরের মৌসুমে তাঁর ইউনাইটেডে ফেরা নিয়েই জেগেছিল সংশয়।