প্রথম ম্যাচ শেষে কার কী অবস্থা?

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক-কীর্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক-কীর্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ছবি: রয়টার্স
>

বিশ্বকাপ একটা চক্র পূরণ করল। প্রতিটি দলই খেলে ফেলেছে একটি করে ম্যাচ। স্বাভাবিকভাবেই সবার প্রত্যাশা ছিল ইতিবাচক কোনো ফলে নিজেদের শুরুটাকে রাঙাতে। কেউ পেরেছে, কেউ পারেনি। তবে একটি করে ম্যাচ শেষে দলগুলোর সামনে একটি নির্দিষ্ট সমীকরণ কিন্তু দাঁড়িয়ে গেছে। সেটি কেমন তা-ই পর্যালোচনার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো অনলাইন

রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচটি দিয়েই শুরু করা যাক। বিশ্বকাপের ৩২ দলের মধ্যে ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা এই দুই দলের খেলায় যে কেউই জিততে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে জেতার সম্ভাবনাটা বেশি ছিল সৌদি আরবেরই। কেননা বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলার আগে টানা আট মাস প্রতিযোগিতামূলক কোনো ম্যাচেই জয়ের দেখা পায়নি রাশিয়া। কিন্তু বিশ্বকাপে মাঠে নেমেই সেই পরিসংখ্যানকে কী দারুণভাবেই না মিথ্যে প্রমাণ করলেন রুশ ফুটবলাররা। জয় তো তুলে নিলেনই, সেটিও হলো ৫-০ গোলের বিরাট ব্যবধানে। কোচ স্তানিস্লাভ চের্চেসভ নিজেও বোধ হয় ভাবেননি তাঁর শিষ্যরা বিশ্বকাপের শুরুটা এমন দুর্দান্ত করবেন। সেদিন মাঠে উপস্থিত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও নিশ্চয়ই বেশ অবাক হয়েছিলেন।

মোহাম্মদ সালাহকে ছাড়াই বিশ্বকাপ শুরু করা প্রথম ম্যাচে মিসর আরেকটু হলেই দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী উরুগুয়েকে আটকে দিয়েছিল। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ডিফেন্ডার হোসে মারিয়া জিমেনেজের অতিরিক্ত সময়ের গোলে পুরো তিন পয়েন্ট নিয়েই মাঠ ছাড়ে লুইস সুয়ারেজের দল। আফ্রিকার আরেক প্রতিনিধি মরক্কোর বিশ্বকাপের শুরুটা মিসরের মতোই হতাশার হয়েছে। তবে তাদের হতাশার মাত্রাটা মিসরের চেয়ে একটু বেশিই। কারণ, নিজেদের প্রথম ম্যাচেই তাদের হার হয়েছে আত্মঘাতী গোলে। আজিজ বুহাদ্দেজের দুর্ভাগ্যজনক আত্মঘাতী গোলে ম্যাচে শেষ হাসি এশীয় প্রতিনিধি ইরানের। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রকে হারানোর পর এই প্রথম বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে জয় পেয়েছে ইরানিরা।

বিশ্বকাপ দ্বিতীয় দিনেই দেখেছে ‘হাই ভোল্টেজ ম্যাচ’। পর্তুগাল আর স্পেনের এই ম্যাচ দর্শকদের উপহার দিয়েছে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। হুট করে ছাঁটাই হওয়া স্পেন কোচ হুলেন লোপেতেগির জায়গায় আসা মাদ্রিদ কিংবদন্তি ফার্নান্দো হিয়েরো কোচ হিসেবে কেমন করেন, সেটি জানার আগ্রহ ছিল সবার। ডিয়েগো কস্তার দুটি অসাধারণ গোল আর ডিফেন্ডার নাচো ফার্নান্দেজের এক গোল মিলিয়ে তিন গোল করা স্পেন হয়তো বিশ্বকাপটা জয় দিয়েই শুরু করতে পারত, পারেনি শুধু একজনের কল্যাণেই।

আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল মেসির জন্য দুঃস্বপ্নের। ছবি: রয়টার্স
আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল মেসির জন্য দুঃস্বপ্নের। ছবি: রয়টার্স

এই বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাটট্রিক করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জানিয়ে দিলেন, এখানে শুধু অন্য দলকে পয়েন্ট বিলানোর জন্য আসেনি তারা। পেনাল্টি, ফ্রিকিক, ডি-বক্সের মধ্যে গোলার মতো শট-কি ছিল না রোনালদোর সেই হ্যাটট্রিকে! ওদিকে স্পেনের গোলরক্ষক ডেভিড ডি গেয়ার ছেলেমানুষি ভুলও এই ম্যাচের আলোচিত বিষয়।

সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে নেইমার নিজেকে ফিরে পাননি। ছবি: রয়টার্স
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে নেইমার নিজেকে ফিরে পাননি। ছবি: রয়টার্স

ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি দেখেছে ভিএআর বা ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি প্রযুক্তির প্রথম সার্থক প্রয়োগ। এই প্রযুক্তির কল্যাণে পাওয়া পেনাল্টি গোলেই প্রথমে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন আঁতোয়ান গ্রিজমান, পরে আরেক পেনাল্টি গোলে অস্ট্রেলিয়াকে সমতায় ফেরান মিডফিল্ডার মাইল ইয়েদিনাক, পরে যদিও আজিজ বেহিচের আত্মঘাতী গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন ফরাসিরা।

মেক্সিকো জার্মানিকে হারিয়ে সৃষ্টি করেছে বড় চমক। ছবি: রয়টার্স
মেক্সিকো জার্মানিকে হারিয়ে সৃষ্টি করেছে বড় চমক। ছবি: রয়টার্স

খুব সম্ভবত এবারই বিশ্বকাপ ট্রফি জয় করার শেষ সুযোগ লিওনেল মেসির। কিন্তু সেই অভিযানের শুরুটা তো শুভ হলো না! মাত্র সাড়ে তিন লাখ লোকের আবাস আইসল্যান্ডের ১১ জন বীর তাঁদের বিশ্বকাপ অভিষেকটাই ভন্ডুল করে দিলেন। মেসি বাহিনীকে আটকে দিল প্রথম ম্যাচে। ১-১ গোলে ড্র করে ঘটাল অঘটন। মেসি করলেন পেনাল্টি মিস। তরুণ স্ট্রাইকার ইউসুফ পোলসেনের গোলে পেরুর বিপক্ষে ১-০ গোলের জয় নিয়ে পুরো তিন পয়েন্ট নিয়ে রাখল ডেনমার্ক। নাইজেরিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে আর্জেন্টিনার গ্রুপে থাকা ক্রোয়েশিয়া শীর্ষে আছে আপাতত, পরের ম্যাচেই তারা লড়বে আর্জেন্টিনার সঙ্গে। সেই ম্যাচে লিওনেল মেসি যদি তাঁর ঝলক দেখাতে না পারেন, বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে যেতে পারে আর্জেন্টিনা!
সার্বিয়ান অধিনায়ক আলেক্সান্ডার কোলারোভ নিজেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে কোস্টারিকার বিপক্ষে ছিনিয়ে আনলেন জয়, দুর্দান্ত এক ফ্রিকিকের গোলে। পরের ম্যাচেই বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল আরেক অঘটনের। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে কাউন্টার আক্রমণে জর্জরিত করে ১-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে মেক্সিকো। বিশ্বমঞ্চে নিজের আবির্ভাব ঘোষণা করেছেন মেক্সিকান উইঙ্গার হিরভিং লোজানো, এই ম্যাচে গোল করেই!

এবারের বিশ্বকাপ এখনো পর্যন্ত ‘আত্মঘাতী’ গোলের বিশ্বকাপ। ছবি: রয়টার্স
এবারের বিশ্বকাপ এখনো পর্যন্ত ‘আত্মঘাতী’ গোলের বিশ্বকাপ। ছবি: রয়টার্স

এবারের বিশ্বকাপ যেন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে, বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের শুধু চমকের পর চমকই উপহার দেবে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার চমকের শিকার ব্রাজিলও। আর্জেন্টিনা, জার্মানির পরে জয়হীন থেকে টুর্নামেন্ট শুরু করেছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। ১-১ গোলে নেইমারদের আটকে দিয়েছে সুইসরা। ভিএআর প্রযুক্তির দ্বিতীয় ব্যবহার এরপরের ম্যাচেই দেখে বিশ্ব, সুইডেন বনাম দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচে। প্রযুক্তির কল্যাণে পাওয়া পেনাল্টি গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়েছে সুইডিশরা। প্রত্যাশিতভাবেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে আসা পানামাকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছে বেলজিয়াম, জোড়া গোল করেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু।

ভিএআর প্রযুক্তির প্রথম প্রয়োগ দেখা গেছে বিশ্বকাপের তৃতীয় দিনেই। ছবি: রয়টার্স
ভিএআর প্রযুক্তির প্রথম প্রয়োগ দেখা গেছে বিশ্বকাপের তৃতীয় দিনেই। ছবি: রয়টার্স

অধিনায়ক হ্যারি কেনের জোড়া গোলে ২-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে ইংল্যান্ডও। এশীয় দেশ হিসেবে চমক দেখিয়েছে জাপানও। তারাই প্রথম এশীয় দল, যারা লাতিন কোনো প্রতিপক্ষকে হারিয়েছে। কলম্বিয়ার ২-১ গোলের এই হার যেন এশীয় ফুটবলের অগ্রযাত্রারও স্মারক। এই ম্যাচেই বিশ্বকাপের প্রথম লাল কার্ড দেখেন কলম্বিয়ার কার্লোস সানচেজ। ২-১ গোলের অমূল্য জয় পায় জাপানিরা। রবার্ট লেভানডোফস্কিকে আটকে রেখে ২-১ গোলের জয় দিয়ে শুভ সূচনা করেছে সাদিও মানের সেনেগালও।

বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত বড় বিস্ময় রাশিয়া। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত বড় বিস্ময় রাশিয়া। ছবি: রয়টার্স

এক ম্যাচেই বোঝা গেছে, এই বিশ্বকাপে তথাকথিত দুর্বল দলগুলো ছেড়ে কথা বলার জন্য আসেনি। এর মধ্যেই আমরা দেখলাম, মাত্র সাড়ে তিন লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড তাদের বিশ্বকাপ অভিষেকেই কীভাবে আটকে দিল আর্জেন্টিনাকে। আইসল্যান্ডের ‘শখের ফুটবলার’ গোলরক্ষক কীভাবে মেসির পেনাল্টি ঠেকিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৫টা আত্মঘাতী গোল হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী গোলের (১৯৯৮ সালে ৬টি) রেকর্ডটা বোধ হয় এবার আর আস্ত থাকছে না।
এ বিশ্বকাপের বাকিটা সময় আরও কত চমক অপেক্ষা করছে কে জানে!