প্রযুক্তির কাটাছেঁড়া: আর্জেন্টিনা বনাম ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ

পুরো ম্যাচেই মেসি ছিলেন নিষ্ক্রিয়। ছবি: এএফপি
পুরো ম্যাচেই মেসি ছিলেন নিষ্ক্রিয়। ছবি: এএফপি
>

কত কত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় এখন ফুটবল মাঠে। এসব প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। প্রযুক্তি-সাহায্য নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনও বিশ্বকাপের বড় ও আলোচিত ম্যাচগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছে। নতুন ধারাবাহিক ‘প্রযুক্তির চোখে’র চতুর্থ পর্ব প্রকাশিত হলো। বিশ্বকাপের আলোচিত আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের বিশ্লেষণ পড়ে নিন। লিখেছেন নিশাত আহমেদ

যেকোনো খেলায় জেতার সবচেয়ে বড় মন্ত্র হলো এমন এক কৌশলে খেলা, যাতে দলের সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড় নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে খেলতে পারেন। এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক। বিশেষত ফুটবলের ক্ষেত্রে। ফুটবল দলগত খেলা হলেও দলের সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে ঘিরেই কৌশল সাজিয়ে গেছেন কোচরা যুগে যুগে। সে হিসেবে আর্জেন্টিনা দলের কৌশল হওয়া উচিত লিওনেল মেসিকে ঘিরেই।

গত রাতে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার ম্যাচে মেসি কি আদৌ খেলতে পেরেছেন? বা তাঁর সতীর্থরাই–বা মেসিকে মধ্যমণি করে খেলতে পেরেছেন কালকের ম্যাচটা? মেসির সামর্থ্যের সর্বোচ্চ উপযোগিতাটুকু কি কাল পেয়েছে আর্জেন্টিনা?

প্রতিটি প্রশ্নের একটিই উত্তর—না। কিন্তু কেন হলো এ রকম? মেসিকে কেন্দ্রবিন্দু করে কেন খেলল না আর্জেন্টিনা? এমন তো না যে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের মতো প্রতিপক্ষ দলের তিন-চারজন খেলোয়াড় মেসিকে ঘিরে রেখেছিলেন! শুধু মেসিকে আটকানোর দিকে লক্ষ্য না রেখে যখনই সুযোগ পেয়েছে, আক্রমণ করেই খেলেছে ক্রোয়েশিয়া।

৩-৪-৩ ছকে খেলা আর্জেন্টিনার মূল একাদশে আক্রমণভাগের মাঝে সার্জিও আগুয়েরোকে রেখে ডান দিকে খেলেছিলেন লিওনেল মেসি, আর বাঁ দিকে খেলেছিলেন ম্যাক্সিমিলিয়ান মেজা। খেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, সেই মেজার দিক থেকে আর্জেন্টিনা প্রায় সব আক্রমণ রচনা করে যাচ্ছে। দলে যে একজন মেসি আছেন, সেদিকে যেন কারোরই খেয়াল নেই! ডান দিক অর্থাৎ মেসির দিক থেকে আর্জেন্টিনাকে আক্রমণ করতে দেখা গেল সামান্যই।


আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের শেষে আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলি একটা কথা বলেছিলেন, ‘মেসিকে যেহেতু দু-তিনজন আটকে রেখেছিল, তার মানে স্বাভাবিকভাবেই মাঠের অন্য প্রান্তে এমন কেউ ছিল যে ফাঁকা ছিল। আমাদের সেই ফাঁকা জায়গাটারই সদ্ব্যবহার করতে হবে’, এই ফাঁকা জায়গার সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে মেসির পায়েই যে আর বল না দেওয়ার পরিকল্পনা এঁটে বসে থাকবেন সাম্পাওলি, তা কে জানত!


আগের ম্যাচে গোল পাননি দেখেই কিনা এই ম্যাচে মেসিকে বলা হয়েছিল একদম ওপরে উঠে খেলতে। ফলে যে জিনিসটা হলো, মিডফিল্ড থেকে আক্রমণ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে হাপিত্যেশ করতে লাগল আর্জেন্টিনা। আর যা আক্রমণ হওয়ার, সব কটিই বাঁ দিক থেকে হওয়া শুরু করল। মেসি বলতে গেলে বলই পেলেন না একদম। এবং পুরো ম্যাচে একই অবস্থা দেখা গেল। নিজেদের কৌশলেই নিষ্ক্রিয় থাকলেন মেসি! পুরো ৯০ মিনিটে ৪৯ বার বল টাচ করতে পেরেছেন মেসি, ভাবা যায়? সফল পাস দেওয়ার হার মাত্র ৭৫%!

কোচের এই ধন্বন্তরি কৌশলে মেসি নিজেও যে প্রচণ্ড বিরক্ত ছিলেন তা জাতীয় সংগীত বাজার সময় থেকে শুরু করে ম্যাচের শেষ পর্যন্ত বোঝা গেছে। ম্যাচের শেষ দিকে নিজের মার্কার ইভান স্ত্রিনিচের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়াটাও খুব সম্ভবত সেই বিরক্তিরই বহিঃপ্রকাশ!


মেসি ও আগুয়েরো, দুজনকেই ওপরে রেখে দিয়ে সাম্পাওলি চেয়েছিলেন মেজা যাতে মাঝেমধ্যে নিচে নেমে মিডফিল্ডারদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আক্রমণ গঠনের কাজ করেন। ফলে আগুয়েরোও মাঠের ওপরে মেসির মতোই বলহীনতায় ভুগেছেন। পুরো ম্যাচে যতক্ষণ ছিলেন, মাত্র ১৬ বার বল স্পর্শ করতে পেরেছেন তিনি!

সাম্পাওলির কৌশলে যে কত বড় ফাঁক ছিল, তা বোঝা যায় দলের ডিফেন্স দেখলেই। ৩-৪-৩ ফরমেশনে তিনজন সেন্টারব্যাক হিসেবে তিনি যাঁদের খেলিয়েছেন, সেই নিকোলাস ওটামেন্ডি, নিকোলাস তাগ্লিয়াফিকো ও গ্যাব্রিয়েল মার্কাদোর মধ্যে প্রথাগত সেন্টারব্যাক ছিলেন শুধু ওটামেন্ডি। বাকি দুজন ক্লাবে ফুলব্যাক হিসেবে খেলেন। ফুলব্যাককে দিয়ে কীভাবে সেন্টারব্যাকের কাজ করানোর কথা চিন্তা করলেন সাম্পাওলি?

ফুলব্যাকদের স্বভাবই হলো মাঝে মাঝে ওপরে উঠে দলের আক্রমণে সহযোগিতা করা, যে বিলাসিতাটা আবার সেন্টারব্যাকরা করতে পারেন না। তিন সেন্টারব্যাকের জায়গায় দুজন ফুলব্যাক খেলানোর কারণে আর্জেন্টিনার মূল একাদশে প্রথাগত সেন্টারব্যাক ছিলেন শুধু একজন, আর এদের নিয়েই সাম্পাওলি একটু হাই লাইন (মাঠের বেশ ওপরে ডিফেন্সের অবস্থান, গোলরক্ষকের কাছাকাছি নয়) খেলার চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টাতেও লাভ হয়নি কোনো। পরিকল্পনা বিহীনভাবে হাই লাইন ডিফেন্সে আক্রমণাত্মক খেলার মাশুল দিয়েছেন ওটামেন্ডি, মারকাদো, আকুনারা—প্রত্যেকেই দেখেছেন একটি করে হলুদ কার্ড।

এবার আসা যাক গোলরক্ষকের ব্যাপারে। উইয়ি কাবায়েরো এককালে অনেক ভালো গোলরক্ষক ছিলেন কোনো সন্দেহ নেই, তবে সেটা তিনি যখন মালাগাতে খেলতেন। সেই কাবায়েরো আর এই ৩৬ বছর বয়সী কাবায়েরোর মধ্যে যে কত তফাত, সেটা প্রথম দুই ম্যাচেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। মূলত চিলিকে সাফল্য এনে দিয়েই সাম্পাওলি আজ এতটা পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন। সেই চিলি দলের মূল গোলরক্ষক ছিলেন ক্লদিও ব্রাভো, যার শট আটকানোর ক্ষমতা গড়পড়তা মানের হলেও বল পায়ে খুবই নিশ্চিন্ত মনে পেছন থেকে আক্রমণটা শুরু করতে পারতেন তিনি।

বল পাস দেওয়ার এই ক্ষমতা এবং পেছন থেকে পাস দিয়ে আক্রমণ গড়ার এই প্রবণতার কারণেই পেপ গার্দিওলা ম্যানচেস্টার সিটিতে এসেই বার্সেলোনা থেকে এই ক্লদিও ব্রাভোকে নিয়ে এসেছিলেন। এই ক্লদিও ব্রাভোই সাম্পাওলির মূল গোলরক্ষক ছিলেন, অর্থাৎ সাম্পাওলির কৌশলের অন্যতম প্রধান অঙ্গ হলো এমন এক গোলরক্ষক থাকা, যে কিনা বল পায়ে স্বচ্ছন্দ। কাবায়েরো ঠিক তার বিপরীত। বল পায়ে এলেই, বা কোনো সতীর্থ ব্যাকপাস দিলেই শতবর্ষী বৃদ্ধের মতো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দেন। ঠিকঠাক পাস দিতে পারেন না, যার চড়া মাশুল কালকে দিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার উইঙ্গার আনতে রেবিচ, কাবায়েরোর এক ভুল পাস ধরেই দুর্দান্ত এক ভলিতে ক্রোয়েশিয়াকে এগিয়ে দেন তিনি।

ম্যাচের শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিলেন মেসিরা, তারপর কোচের এসব আত্মঘাতী কৌশল আর কাবায়েরোর সেই ভুলের পর আত্মবিশ্বাস যেন একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকে আর্জেন্টাইনদের। এখনো কিছু সমীকরণ মিললে দ্বিতীয় রাউন্ডে হয়তো উঠতে পারে তারা। কিন্তু তারপর?

আর্জেন্টিনার ফুটবলে ধেয়ে আসছে ঘোর অমানিশা।