রোনালদোদের বিদায় করে উরুগুয়ে শেষ আটে

জোড়া গোল করা কাভানির মুখেই এই হাসি মানায়। ছবি: রয়টার্স
জোড়া গোল করা কাভানির মুখেই এই হাসি মানায়। ছবি: রয়টার্স
পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ে। এই হারে পর্তুগালের সঙ্গে বিদায় নিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও। জোড়া গোল করেছেন উরুগুয়ে স্ট্রাইকার এডিনসন কাভানি

আগের ম্যাচে বিদায় নিয়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-সমর্থকদের মনে তাই ভীতিটা ছিল। একই রাতে পর্তুগালকেও বিদায় নিতে হবে না তো! শেষ পর্যন্ত এই ভীতিটাই সত্য হলো। ‘ক্ল্যাসিক’ এডিনসন কাভানির জোড়া গোলে মেসির পথেই হাঁটতে হলো রোনালদোকে। পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে উরুগুয়েও উঠে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে।

শেষ ষোলোর এ লড়াইয়ের ভাগ্য যে মূলত তিনজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করছে তা অনুমিতই ছিল। পর্তুগালের ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ রোনালদো বনাম উরুগুয়ের কাভানি-সুয়ারেজ জুটি। রোনালদোকে রক্ষণে বোতলবন্দী রাখার পরীক্ষায় পাস করে গেছেন উরুগুয়ে কোচ অস্কার তাবারেজ। প্রথমার্ধে উরুগুয়ের বক্সে রোনালদোকে বল ছুঁতে দেয়নি গোডিন-জিমিনেজ-ক্যাকেরেসদের রক্ষণ। বিরতির পর শেষ দিকে কয়েকবার উরুগুয়ের বক্সে ঢুকেও গোল আদায় করতে পারেননি রোনালদো। ৩৩ বছর বয়সী এই তারকার সম্ভবত এটাই শেষ বিশ্বকাপ। খালি হাতেই ফিরতে হলো তাঁকে।

রোনালদো এ জন্য পর্তুগিজ রক্ষণকে দুষতে পারেন। পেপে-ফন্তে-পেরেইরাদের রক্ষণ যে প্রথমার্ধেই সুয়ারেজ-কাভানি জুটিকে আটকে রাখতে পারেনি। ৭ মিনিটে দলীয় আক্রমণের ধারাবাহিকতায় বাঁ প্রান্ত থেকে বাতাসে ক্রস ভাসিয়েছিলেন সুয়ারেজ। উদ্দেশ্য, ডান প্রান্তে বক্সের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কাভানি। উরুগুয়ে স্ট্রাইকার যেন ওত পেতে ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কাভানিকে বাধা দেওয়ার মতো পর্তুগিজ রক্ষণে কেউ ছিল না! সুযোগ বুঝে কিছুটা লাফিয়ে দারুণ হেডে বলটা জালে পাঠাতে তাঁর কোনো সমস্যাই হয়নি। কাভানি যে দ্বিতীয় গোল পেতে পারেন, সেটা আন্দাজ করা গেছে অ্যাটাকিং থার্ডে তাঁর নিবেদন দেখে। বক্সে বল পেলেই ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন পর্তুগিজ-সমর্থকদের।

সেই ভীতিটা সত্যি হয়েছে ৬২ মিনিটে। এবারও পর্তুগালের এক ডিফেন্ডারের ভুল হেডের সুযোগ নিয়ে ফার্নান্দো স্যান্টোসের রক্ষণভাগকে চেপে ধরেন সুয়ারেজ-বেনতাঙ্কুর-কাভানি। পর্তুগিজ বক্সের সামনে ডান প্রান্ত থেকে বেনতাঙ্কুরের ডিফেন্স চেরা পাসকে কাভানি যেভাবে গোলে পরিণত করেছেন, তা ‘লা সেলেস্তে’ সমর্থকদের মনে থাকবে অনেক দিন।

কোণটা দুরূহ ছিল, কাভানি তাই বুটের ডগা দিয়ে বাঁকানো শটে বলটাকে শুধু বাতাসে ভাসিয়ে গেঁথে দেন পর্তুগিজ-সমর্থকদের হৃদয়ে। বলটা জালে জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটা পর্তুগিজ–সমর্থকদের বুকে শেল হয়েই বিঁধেছে। ২-১ গোলে এগিয়ে যায় উরুগুয়ে। তার আগে ৫৫ মিনিটে হেডে সমতাসূচক গোল করে পর্তুগালের আশা জিইয়ে রেখেছিলেন পেপে। কিন্তু সেই আশার অপমৃত্যু ঘটেছে কাভানির দুর্দান্ত গোলে। যোগ করা সময়ে পর্তুগাল গোল করার দুটি সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারেনি।

চোট না পেলে কাভানি হয়তো হ্যাটট্রিকও তুলে নিতে পারতেন। ৭০ মিনিটের পরপরই খোঁড়াতে দেখে তাঁকে মাঠ থেকে তুলে নেন তাবারেজ। কাভানির মাঠ ছাড়ার দৃশ্যটিও মনে রাখবেন ফুটবলপ্রেমীরা। উরুগুয়ে স্ট্রাইকার মাঠের বাইরে গেছেন রোনালদোর কাঁধে ভর করে—ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতো এক মুহূর্ত!

এরপর বেশ কটি গোলের সুযোগ পেয়েছে পর্তুগাল। বিশেষ করে ৮০ মিনিটের পর থেকে তাঁরা বারবার আক্রমণ করেছে উরুগুয়ে রক্ষণে। পাওলো গেরেরে তো ফাঁকা পোস্ট পেয়েও বল মেরেছেন উড়িয়ে। উরুগুয়ে গোলরক্ষক ফার্নান্দো মুসলেরা বক্সের জটলার মধ্যে ‘গ্রিপ’ করতে ব্যর্থ হলে বল পেয়ে যান গেরেরো। পোস্ট ফাঁকা পেয়েও তিনি কীভাবে বল বাইরে মারলেন, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। এ ছাড়া যোগ করা সময়ে রিকার্ডো কারেসমার শট তো প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিল জালে। কিন্তু গোলরক্ষক ফার্নান্দো মুসলেরার দৃঢ়তায় উরুগুয়ে সেযাত্রায় রক্ষা পায়।

তাবারেজের রক্ষণ কতটা শক্তিশালী, তার প্রমাণ পরিসংখ্যান। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে কোনো গোল হজম করেনি উরুগুয়ে। এই ম্যাচে পেপের গোলটি ছাড়া উরুগুয়ে রক্ষণের ভুল নেই। তবে রোনালদো এই রক্ষণ ভাঙতে কম চেষ্টা করেননি। গোটা ম্যাচে তিনি ৬টি শট নিয়েছেন, যা গোটা উরুগুয়ে দলের নেওয়া শটসংখ্যার চেয়ে একটি বেশি। কিন্তু উরুগুয়ের গোলপোস্টে রাখতে পেরেছেন মাত্র ২টি শট। প্রথমার্ধে বলে মোট ২৪টি ‘টাচ’ করেছেন রোনালদো। কিন্তু এর একটাও উরুগুয়ে বক্সের মধ্যে নয়।

আবেগবাদী ফুটবলপ্রেমীরা তাই এখন ভাবতেই পারেন, অলক্ষ্যে বসে এই চিত্রনাট্য বুঝি আগেই লেখা ছিল! আগের ম্যাচে বিদায় নিলেন মেসি। পরের ম্যাচে সেই পথে হাঁটলেন মেসিরই প্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদো। এখন প্রশ্ন হলো, এটাই কি তাঁদের শেষ বিশ্বকাপ হয়ে থাকল? জবাবটা শুধু তাঁরাই জানেন। যদিও দুজনের বয়সের অঙ্ক বলছে, কাতার বিশ্বকাপে তাঁদের না-ও দেখা যেতে পারে। ৩১ বছর বয়সী মেসির ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা কিছুটা উঁকি দিলেও রোনালদোর ক্ষেত্রে তা নেই বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে শেষ ষোলো থেকেই সেরা দুই তারকার বিদায়ে বিশ্বকাপ কি রং হারাল?

তা তো কিছুটা হারালোই। তবে বিশ্বকাপ এমন টুর্নামেন্ট যেখানে তারকাদের বিদায়ের মঞ্চেই নতুনের জন্ম হয়। মেসি-রোনালদো না হয় নেই, কাভানি-সুয়ারেজ কিংবা এমবাপ্পেরা আছেন তো!