কাজানে নীরব মেসিরা

ম্যাচ শেষে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের হতাশাই বলে দিচ্ছে তাঁদের মানসিক অবস্থা। ছবি: রয়টার্স
ম্যাচ শেষে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের হতাশাই বলে দিচ্ছে তাঁদের মানসিক অবস্থা। ছবি: রয়টার্স

কাজান অ্যারেনা স্টেডিয়ামের গায়ে যে এলইডি পর্দাটা লাগানো, এত বড় এলইডি পর্দা বিশ্বের আর কোথাও নেই। একদিকে কাজানের প্রধান দ্রষ্টব্য কাজান ক্রেমলিনের ছবি ভেসে উঠছে, অন্যদিকে ড্রাগনের। মাঝখানে মাসকট জাবিভাকা একটু হাসিমুখে দৌড়াদৌড়ি করছে। খানিক পরপর দেখানো হচ্ছে সেই ম্যাচের ফল: ফ্রান্স ৪:৩ আর্জেন্টিনা। 

আর্জেন্টাইনদের কাছে এ বড় বেদনার ছবি। ফরাসিদের কাছে আনন্দের। নীল-সাদায় আবৃত কয়েকটি সমর্থক দল খানিক দাঁড়িয়ে সেই ছবি দেখে মুখ নিচু করে চলে গেল। ফ্রান্সের কয়েকজন সমর্থক ফলটা একবার ভেসে উঠতেই করতালিতে বইয়ে দিলেন আনন্দের বন্যা।
এই দৃশ্য ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরের। এর মধ্যে সংবাদ সম্মেলন হয়ে গেছে। মিক্সড জোন দিয়ে সার বেঁধে মূর্তির মতো বেরিয়ে গেছেন মেসিরা। কথা বলতে চাননি কেউই। তবে তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে মায়াই হয়েছে সাংবাদিকদের।
কথা বলেছেন শুধু হাভিয়ের মাচেরানো এবং বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন, আর্জেন্টিনার হয়ে জীবনের শেষ ম্যাচটি খেলে গেলেন কাজানে। ৩৪ বছর বয়সী ডিফেন্ডার (মিডফিল্ডার, পেপ গার্দিওলা বার্সেলোনায় তাঁকে সেই যে ডিফেন্ডারের পরিচয় দিলেন, সেটিই এখনো বয়ে বেড়াতে হয় তাঁকে) ভলগার তীরে ফেলে গেলেন আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়ের পরিচয়। ১৯ বছর আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে চাপানোর পর সেটি চিরতরেই খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন আগের কথামতো। অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ—মাচেরানো ধন্যবাদ জানালেন সব আর্জেন্টাইনকে। তাঁর দুঃখ, বিদায়বেলার স্মৃতিটা মধুর হলো না।
‘আমি আমার শরীরের প্রতিটি ঘামের বিন্দু দিয়ে লড়েছি দেশের জন্য। বিনিময়ে সবার ভালোবাসাও পেয়েছি, এটা চিরদিন মনে রাখব’—বাক্যটি পুরো শেষ করতে পারেননি, আগেই এসে গেছে কান্নার দমক...।

ঝড়ের মুখে পড়েও নকআউটে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু নকআউটের প্রথম পর্বেই মৃত্যু হলো স্বপ্নের। ২০০২ বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বাজে ফল। মাচেরানো ক্ষমা চেয়েছেন দলকে আরও দূরে নিয়ে যেতে না পারায়। অবশ্য আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র আর ক্রোয়েশিয়ার কাছে পরাজয়ের পর আলবিসেলেস্তির সমর্থকেরা ছিলেন ক্ষুব্ধ, ক্ষমাহীন। কাজানে নিজেদের রক্তাক্ত সন্ধ্যায় দেখা গেল, বিশাল সমর্থক বাহিনী আশ্চর্য রকমের শান্ত। তারা মেনে নিয়েছে সহজেই। মেসি-ডি মারিয়াদের লড়াইটা তো তারা দেখেছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই জীবন অন্য রকম হতে পারত। যদি অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে ডি মারিয়ার শটটা গোলমুখে থাকত, যদি মেসি শেষ দিকে তাঁর শটটা গোলকিপারের হাতে তুলে না দিতেন, ম্যাচটি যেতে পারত অতিরিক্ত সময়ে।
মাচেরানোর সঙ্গে জাতীয় দলকে বিদায় জানিয়েছেন লুকাস বিগলিয়াও। তবে মেসি এখনো কোনো কথা বলেননি। নীরব হয়ে রয়েছেন। কে জানে আচম্বিতেই কোনো ঘোষণা দিয়ে ফেলেন কি না। তবে আর্জেন্টিনার সাংবাদিক মহলের অনেকেরই দৃঢ় ধারণা, মেসি অবসর নেবেন না এখনই।

অবসরের কথা ভাবছেন না কোচ হোর্হে সাম্পাওলিও। সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ব্যর্থতার দায় নিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কোনো ভাবনা তাঁর মাথায় নেই।
সাম্পাওলি ধন্যবাদ জানিয়েছেন সব আর্জেন্টাইনকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই যখন আর্জেন্টিনা এগিয়ে যায় ২-১ গোলে, তখন আর্জেন্টাইন কোচ ভেবেছিলেন ম্যাচটি তাঁদের। শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি বলে তিনি দুঃখিত। তিনি আশায় আছেন নতুন করে শুরু হবে আর্জেন্টিনার।

শুরুটা আসলেই নতুন করে যেমন হলো ফ্রান্সের। দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলেও ফ্রান্সের খেলা উজ্জ্বল কিছু ছিল না। সব উজ্জ্বলতা ফিরে পেল তারা আসল ম্যাচেই। এ তো আসলে নতুন সূচনা। আর সূচনা হলে বাকি থাকে শুধু এগিয়ে যাওয়া। এমবাপ্পে, গ্রিজমানদের ক্যারাভানের এখন সামনে ছোটার সময়। মিক্সড জোনে ফ্রেঞ্চ খেলোয়াড়েরা সব সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছেন মন খুলে। আজ তাঁদের মন খুলে কথা বলার দিন।

স্টেডিয়াম থেকে বেরোনোর সময় বিশ্ববিদ্যালয় গেমস উপলক্ষে নির্মিত বিশাল সুইমিংপুলের কাছে দেখা হলো আনার সঙ্গে। ঢোকার সময় ফরাসি মেয়েটি তাঁর ছেলেবন্ধুকে নিয়ে পড়ে গিয়েছিল নীল-সাদা রঙের আর্জেন্টাইন স্রোতের মধ্যে। নিঃসঙ্গ লাগছে কি না জানতে চাইলে আনা বলেছিল, ‘ওদের আনন্দ করতে দাও, আজই তো ওদের শেষ দিন। আর সময় পাবে না।’
কী নির্মম সত্যি হয়ে উঠল আনার কথাগুলো। ম্যাচ শুরুর আগের নীল-সাদা সমুদ্র ম্যাচ শেষে একেবারে নীরব। সেখানে জেগে উঠেছে লাল-নীল-সাদার ঢেউ। কাছের বিশাল জলাভূমি থেকে বকের মতো দু-একটি পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে, আর্জেন্টাইনদের কাছে তা লাগছে নিশুতির মতো। ফুটবল এমনই।