যুদ্ধের মাঠ থেকে বিশ্বকাপের ফাইনালে

একজন যোদ্ধা যখন বিজয়ী হন, তিনি লুকা মডরিচ। ছবি: রয়টার্স
একজন যোদ্ধা যখন বিজয়ী হন, তিনি লুকা মডরিচ। ছবি: রয়টার্স
রাশিয়া বিশ্বকাপে এবারের ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে উঠে যাওয়া বিশ্বকাপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গল্প। রাকিতিচ, মানজুকিচ আর অবশ্যই মডরিচের কল্যাণে আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম ফাইনালে উঠে গেছে ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়া। এ দলের খেলোয়াড়দের শৈশব যেভাবে কেটেছে সেখান থেকে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলার ইতিহাসটা অবিশ্বাস্য। লুকা মডরিচের গল্পটা না জানলেই নয়!


ক্লাবের হয়ে খেলেন ইউরোপের সেরা ক্লাবটিতে। জিতেছেন লিগ, ইউরোপ সেরার একাধিক ট্রফি। কয়েক বছর ধরে রিয়াল মাদ্রিদের মিডফিল্ডের মূল ভরসা হয়ে উঠেছেন লুকা মডরিচ। কিন্তু দেশ তাঁর ক্রোয়েশিয়া। ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবস্থান ২০। বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নেয় ১৯৯৮ সালে। এই দলকে নিয়ে আর কত দূর যাওয়া যায়, এমনটা বলতেন ফুটবল বোদ্ধারাও। কিন্তু রাকিতিচ, মানজুকিচদের দলটিকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে এসেছেন লুকা মডরিচ। আর এই লড়াই শিখেছেন জীবন থেকে। একজন শরণার্থী যখন জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে পারে, ফুটবলের মাঠে যুদ্ধ কি তখন খুব বেশি কঠিন!

নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ২০০৬-এ খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা যায়নি মডরিচের। ম্যাচগুলোতে পুরো সময় খেলার সুযোগ পাননি সেবার। ২০১০ সালে বিশ্বকাপই নিশ্চিত করতে পারেনি তাঁর দেশ। ২০১৪ সাল। বিশ্বকাপের এক মাস আগে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। বিশ্বকাপে নিজের সেরা ফর্ম নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন সেবার। কিন্তু সেবারও ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি। তবে রাশিয়ায় এসে ক্রোয়েশিয়ার অন্য এক রূপ দেখল ফুটবল বিশ্ব।

১৯৫৮ সালে পেলের পর থেকে ২০১০ সালে ইনিয়েস্তা পর্যন্ত কিংবদন্তিদের হাতেই উঠেছে বিশ্বকাপ ট্রফি। সেই তালিকায় নিজেকে দেখতে আর মাত্র এক ধাপ দূরে বর্তমান সময়ের সেরা এই মিডফিল্ডার। ‘ক্লাবের হয়ে লুকার সব জেতা সম্ভাব্য হয়েছে কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে কিছু পাওয়া হয়নি। এটা মনে হয় লুকার জীবনের সেরা সময়। সে তার জীবনের সেরা ফুটবল খেলছে এখন।’ ইংল্যান্ডের সঙ্গে সেমিফাইনালে জেতার পর এমন মন্তব্য করেছিলেন কোচ দালিচ।

অথচ মডরিচ এই পর্যায়ে না-ও আসতে পারতেন। তাঁর বাল্যকাল ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। ক্রোয়েশিয়ায় স্বাধীনতা অর্জনের সময় জাদারে অবস্থিত শরণার্থী হোটেলে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে। ২৭ বছর আগের সেই হোটেল এখনকার মতো আধুনিক ও সুযোগ-সুবিধা ছিল না। সার্বিয়ান আর্মিরা ঘিরে ছিল সেই এলাকা। মডরিচের দাদাকে তারা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিল। এমন দিনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ের সেরা এই মিডফিল্ডারকে যেতে হয়েছে।

‘আমার যেটা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সেটা হলো আমরা সব সময় ভয়ের মধ্যেই থাকতাম। মডরিচের জাদারে থাকা অবস্থায় সেখানকার স্থানীয় কোচ টমিস্লাভ বেসিক সে সময়ের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেন এভাবেই, ‘হাজার হাজার গ্রেনেড, চারপাশের পাহাড় থেকে গুলি বর্ষিত হতো, এমনকি সেগুলো মাঠেও পড়ত, সব সময় আশ্রয়ের জন্য আমাদের দৌড়াতে হতো। ফুটবল ছিল বাস্তবতা থেকে আমাদের লুকিয়ে থাকার একমাত্র সম্বল।’

যখন দেশে যুদ্ধ চলছিল, তখনো জীবনে ফুটবল ছিল মডরিচের। ফাইল ছবি
যখন দেশে যুদ্ধ চলছিল, তখনো জীবনে ফুটবল ছিল মডরিচের। ফাইল ছবি

মডরিচ ইতিবাচকভাবে দেখেন জীবনকে। না হলে কি আর এত দূর আসা যায়! তাঁর মতে, ‘আমাদের অভিভাবক আমার বোনেরা আর আমি যাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি, তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। যদিও যুদ্ধ ও শরণার্থী অবস্থায় থাকা, এমন পরিবেশের মধ্য দিয়ে জীবনে যেতে হয়েছে, আমার একটা স্বাভাবিক শৈশব ছিল অন্য আর দশটা শিশুদের মতো।’

যুদ্ধের মাঠ থেকে নেমেছেন ফুটবলের মাঠে। প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাসের এক নাম লুকা মডরিচ। টটেনহামের হয়ে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ফুটবলে খেলেছেন দুর্দান্ত। রিয়াল মাদ্রিদের যোগ দেওয়ার পর থেকে বিশ্বের অন্যতম তো বটেই, অনেকের মতে এখনকার সেরা মিডফিল্ডার তিনি। এখন জাতীয় দলের হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার সময়। আর মাত্র একটি ম্যাচ। যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফেরা সেই শিশুটির হাতে ফুটবল বিশ্বকাপের ট্রফিটি উঠলে, অসাধারণ একটি ঘটনাই হবে।