কাতারকে হারিয়ে ইতিহাস বাংলাদেশের

এশিয়ান গেমসের ফুটবলে এর আগেও বেশ কয়েকবার জিতেছে বাংলাদেশ। ১৯৮২ সালে মালয়েশিয়া, ১৯৮৬ সালে নেপাল, ২০১৪-তে আফগানিস্তান; কিন্তু জাকার্তায় আজ বাংলাদেশ যে জয়টা পেল সেটির সঙ্গে তুলনীয় নয় আগের কোনোটিই। শক্তিশালী কাতারের বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়টি যে বাংলাদেশকে নিয়ে গেল এশিয়াড ফুটবলের নকআউট পর্বে। খেলার একেবারে যোগ করা সময়ে অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার গোলে নিশ্চিত বাংলাদেশের ফুটবলের নতুন ইতিহাস।

ম্যাচটা বাংলাদেশ খেলতে নেমেছিল জয়ের লক্ষ্য নিয়েই। আগের ম্যাচে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে জিততে জিততে ড্র করে নক আউট পর্বের স্বপ্নটা দেখতে শুরু করেছিল দল। গ্রুপের সবচেয়ে শক্তিশালী দল উজবেকিস্তানের বিপক্ষে কাতার বড় ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর ‘আমরাও কাতারকে হারাতে পারি’ এই বিশ্বাসটা দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত শেষ হাসিটা হাসল বাংলাদেশই। দেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগে যেটি হয়নি, সেটিই করে দেখাল বাংলাদেশের তরুণ ফুটবলাররা। এশিয়ান গেমসের ফুটবলের দ্বিতীয় পর্ব বা নকআউট পর্বে পা রাখাটা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য বিরাট অর্জনই।

>দেশে ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ জাকার্তায় কাতারকে ১-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমসের নক আউট পর্বে বাংলাদেশ। খেলার একেবারে শেষ মুহূর্তে জয়সূচক গোলটি আসে অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার পা থেকে।


ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে ৯৮তম স্থানে কাতার। আর বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৪। ২০২২ সালে এই কাতারই আয়োজন করবে বিশ্বকাপ ফুটবলের। আজ জয়ের লক্ষ্যে মাঠে নামা বাংলাদেশের ফুটবলাররা চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় লড়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী এই ফুটবল-শক্তির বিপক্ষে। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নটা পুরোপুরি বাস্তব বাংলাদেশের ফুটবলে।
আজকের ম্যাচের আগে গ্রুপ ‘বি’র সমীকরণটা ছিল এমন—দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে কাতারকে অবশ্যই জিততে হবে। বাংলাদেশকেও জিততে হবে। তবে ড্র করলেও সেরা তৃতীয় স্থান অধিকারী হিসেবে পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ ছিল বাংলাদেশের সামনে। তবে থাইল্যান্ড যদি উজবেকিস্তানকে হারিয়ে দিত, তাহলে উজবেকিস্তানের সঙ্গে পরের রাউন্ডে সঙ্গী হতো তারাই। উজবেকিস্তান থাইল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়ায় কাতার ও বাংলাদেশের পথটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তবে কাতার চাপ তৈরি করে খেলেও বাংলাদেশের রক্ষণ সেনাদের দৃঢ়তায় সুবিধা করতে পারেনি। তবে প্রথমার্ধের ১৭ মিনিটের মধ্যে এই ম্যাচে বাংলাদেশ যদি ২-০ গোলে এগিয়ে যেত তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকত না। আগের ম্যাচে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে গোলদাতা মাহবুবুর রহমান সুফিল ওই সুযোগ দুটি হেলায় হারান। প্রথমবার সুফিল নিজেই ডান প্রান্ত দিয়ে কাতারি রক্ষণভাগকে ফাঁকি দিয়ে বক্সের মধ্যে ঢুকে যে শটটি নেন সেটি দ্বিতীয় বারের পাশ দিয়ে চলে যায়। পরে কাতারের রক্ষণের ভুল বোঝাবুঝিতে ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে বল পেলেও সেটি গোলরক্ষকের শরীরে মেরে নষ্ট করেন ঢাকার ফুটবলের উদীয়মান এই তরুণ।
প্রথমার্ধে কাতারও কয়েকটি সুযোগ নষ্ট করে। এর মধ্যে একটি ফ্রিকিক বাংলাদেশের পোস্টে লেগে প্রতিহত হয়। রক্ষণে তপু বর্মণ, বিশ্বনাথ ঘোষরা গোটা ম্যাচেই কাতারের ফরোয়ার্ডদের পায়ের সঙ্গে লেগে থেকে বল প্রতিহত করেছেন। তবে প্রথমার্ধে বাংলাদেশের মিডফিল্ডাররা কিছুটা নিষ্প্রভ থাকায় কাতার বারবার বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছে। প্রথমার্ধে জমাল ভূঁইয়ার কর্নার থেকে তপুর দুর্দান্ত হেডটি প্রতিহত করে কাতারের গোলরক্ষক।
দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ কিছুটা গা ছাড়া দিয়ে ওঠে। আক্রমণের ধারও বাড়ায়। তবে সবগুলি আক্রমণই ছিল প্রতি আক্রমণ থেকে। এ সময় কাতার গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় ফাঁক-ফোকর তৈরি হচ্ছিল প্রায়ই। কিন্তু সে সুযোগগুলি থেকে পরিকল্পনামতো মাথা খাঁটিয়ে গোলের সুযোগ তৈরিতে দুর্বলতা ছিল বাংলাদেশের আক্রমণভাগের। এই অর্ধে সুফিল, সাদউদ্দিনরা কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়লে তাদের তুলে নেন কোচ জেমি ডে। সুফিলের বদলে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও সাদের বদলে মতিন মিয়া মাঠে নামলে কিছুটা আক্রমণের ধার বাড়ে। তবে আবদুল্লাহ একটি সুযোগ নষ্ট করেন বক্সের মধ্যে মাথা ঠান্ডা রাখতে না পারার কারণে।
খেলা যত গড়িয়েছে কাতার দলের খেলা তত বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে। এর জন্য কৃতিত্ব দিতেই হবে বাংলাদেশের রক্ষণকে। গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানাও ভালো খেলেছেন। পেছন থেকে রক্ষণের নেতৃত্বটা আসলে দিয়েছেন তিনিই। সুশান্ত ত্রিপুরাও তপু-বিশ্বনাথ ও টুটুল হোসেন বাদশাদের সঙ্গে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে লড়েছেন।
খেলা শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলাদেশ জয় সূচক গোলটি পেয়ে যায়। কিন্তু নিজেদের বেশ খানিকটা ভাগ্যবান ভাবতে পারে বাংলাদেশ দল। কাতারের একটি আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বল বক্সের মধ্যে সুশান্ত ত্রিপুরার হাতে লাগলেও রেফারির দৃষ্টিতে সেটি পেনাল্টি দেওয়ার মতো ‘অপরাধ’ ছিল না। পরের আক্রমণ থেকেই ইতিহাস রচিত হয় বাংলাদেশের। প্রতি আক্রমণ থেকে বল পেয়ে জামাল ভূঁইয়া প্রায় একক প্রচেষ্টায় কাতারের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের বোকা বানিয়ে বল জালে ঠেলে দেন।
এশিয়ান গেমসের গ্রুপিং হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ‘যতটা ভালো করা যায়’। প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিশ্চিত ভেবে নিয়ে ২১ আগস্ট দেশে ফেরার ফ্লাইট ও বুকিং দিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কাতারের বিপক্ষে দারুণ জয়ে এখন মধুর ঝামেলার মুখোমুখি বাংলাদেশ।
নক আউট পর্বে আগামী ২৪ আগস্ট ইরানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।