বিশ্বকাপের স্বাগতিকদের হারানো, কত বড় এ জয়?

বাদল রায়ের গোলে ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়াডে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে এসেছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। ছবি: ফাইল ছবি
বাদল রায়ের গোলে ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়াডে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে এসেছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। ছবি: ফাইল ছবি
>কাতারকে হারিয়ে এশিয়ান গেমসের নকআউট পর্বে উঠে যাওয়াটা কত বড় সাফল্য? ফুটবলের বর্তমান অবস্থায় এটি অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয় এক অর্জন। যে কাতার ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক, তাদের হারিয়ে দিয়ে ফুটবলের নতুন দিনের সূচনাই যেন হয়ে গেছে কাল

এশিয়ান গেমস ফুটবলে কাতারকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ! বাংলাদেশের ফুটবলের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনাই। যে কাতার পরের বিশ্বকাপের আয়োজক, এশীয় ফুটবলের অন্যতম বড় শক্তি হিসেবে যে দেশটি পরিচিত, তাদেরই কিনা হারিয়ে দিল বাংলাদেশ! এটি কেবল একটি জয়ই নয়, নতুন এক ইতিহাসও। এই জয়ে যে প্রথমবারের মতো এশিয়াড ফুটবলে গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে বাংলাদেশ নিশ্চিত করল নকআউট পর্ব। বাংলাদেশের ফুটবলে গতকালের দিনটি সত্যিই সোনার হরফে লেখা থাকবে।

ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে—নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৪। একসময় ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের যে একটা ভালো অবস্থান ছিল, সাম্প্রতিক কালে তা-ও নেই। ভারত, মালদ্বীপ তো বটেই, হালে নেপাল, এমনকি ভুটানও বাংলাদেশকে র‍্যাঙ্কিংয়ে পেছনে ফেলেছে। ২০০৩ সালে দেশের মাটিতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা বাংলাদেশ এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় শেষ চারে খেলেছিল ৯ বছর আগে। ২০১১, ২০১৩ ও ২০১৫—সাফের সর্বশেষ তিনটি আসরে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। এশিয়ান কাপের প্রাক্‌ বাছাইপর্বে ভুটানের বিপক্ষে একটি ম্যাচে হেরে ব্যর্থতার ষোলোকলাও পূর্ণ করা হয়ে গেছে। এমনই যখন দেশের ফুটবলের অবস্থা, ঠিক তখনই কাতারের মতো এশিয়ার শীর্ষ একটি দলকে হারিয়ে এশিয়ান গেমসের নকআউট পর্বে স্থান করে নেওয়াটা দীর্ঘ খরার পর একপশলা বৃষ্টির মতোই।

এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ প্রথম জয় পেয়েছিল আজ থেকে ৩৬ বছর আগে। ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়ান গেমসে বাদল রায় আর আশিস ভদ্রের গোলে মালয়েশিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সে আসরেই চীন ও ভারতের কাছে বাংলাদেশ হেরেছিল। পরেরবার ১৯৮৬ সিউল এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ জয়ের ধারা ধরে রেখেছিল—শেখ মোহাম্মদ আসলামের গোলে জয় তুলে নিয়েছিল নেপালের বিপক্ষে। কিন্তু গ্রুপের অন্য তিনটি দলে জাপান, ইরান ও কুয়েতের বিপক্ষেই বাংলাদেশ হেরেছিল ৪-০ গোলে। ১৯৯০ বেইজিং এশিয়ান গেমসে জাপান ও সৌদি আরবের বিপক্ষে বাংলাদেশ হেরেছিল যথাক্রমে ৩-০ ও ৪-০ গোলে।

১৯৯৪ হিরোশিমা ও ১৯৯৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ ফুটবল দল পাঠায়নি। ২০০২ সালে বুসান এশিয়াড থেকে আবারও ফুটবলে অংশ নেওয়া শুরু করলেও একটি জয় পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৪ সালের ইনচন এশিয়ান গেমস পর্যন্ত। গত এশিয়ান গেমসে মামুনুল ইসলামের গোলে আফগানিস্তানকে হারিয়ে ২৮ বছর পর এশিয়াডে জয়ের দেখা মেলে। ইতিহাস বাংলাদেশ গড়তে পারত গতবারই।

আফগানিস্তানকে হারালেও উজবেকিস্তানের কাছে ৩-০ গোলে আর হংকংয়ের বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে নকআউট পর্বে জায়গা করে নেওয়া হয়নি বাংলাদেশের। হংকংয়ের বিপক্ষে ম্যাচটিতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েও আত্মঘাতী গোলে হার মানতে হয়েছিল। সে ব্যথা বাংলাদেশ এবার ঘোচাল। এমন একটা সময় সাফল্যটি এল, যেটির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না ফুটবলপ্রেমীরা। এবার জাকার্তায় থাইল্যান্ডের সঙ্গে ড্র আর কাতারের বিপক্ষে জিতে এশিয়াডের পরের রাউন্ডে চলে যাওয়াটা ফুটবলের হাল-হকিকত বিচারে অবিশ্বাস্যই।

এশিয়াডে একসময় ফুটবলে সব দেশের জাতীয় দলই খেলত। ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে প্রথম অংশ নিয়ে ভারত ও মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই হার সঙ্গী হয়েছিল। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিতে বাংলাদেশ হেরেছিল ৩-০ গোলে। ১৯৮২, ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালে জাতীয় দল খেলেছিল। ২০০২ সালে থেকে অলিম্পিকের মতোই ফুটবলে অনূর্ধ্ব-২৩ দল খেলানো নিয়ম করে দেওয়া হয়। অলিম্পিকে যেমন অনূর্ধ্ব-২৩ দলের সঙ্গে পাঁচজন সিনিয়র দলের খেলোয়াড় খেলতে পারে, এশিয়াড ফুটবলের নিয়মও তা-ই।

গতকাল কাতারের যে দলটিকে বাংলাদেশ হারিয়েছে, সেটি তাদের অনূর্ধ্ব-২৩ দলই। বাংলাদেশ দলটিও ছিল অনূর্ধ্ব-২৩। সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে এই দলে ছিলেন জামাল ভূঁইয়া, গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানা ও তপু বর্মণ। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দল যদি ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে ৯৬ ধাপ এগিয়ে থাকা একটি দলের বিপক্ষে জয় পায়, তাহলে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সেটিকে বড় সাফল্যই বলতে হয়। আর কাতারকে হারানোয় এই জয় হয়ে উঠেছে আরও মহিমান্বিত। ২০২২ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক কাতার বিশ্বকাপ খেলবে।

আর নিশ্চিতভাবেই গতকালকের ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে হারা দলটির বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় সে দলের অংশ হবেন। বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশের বিপক্ষে জয়কে যদি কেউ এ দেশের ফুটবলেরই সেরা সাফল্য হিসেবে ধরে নেন, তাহলে তাঁকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। এসএ গেমসে সোনার পদক কিংবা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের চেয়েও কেউ যদি কাতারের বিপক্ষে জয়টিকে বড় করে দেখাতে চান, সেটি খুব ভুল হবে না।

ফুটবল তলানিতে ঠেকে গিয়েছিল। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথগুলো দেখা যাচ্ছে। কাতারের বিপক্ষে এই জয়টা গত এক-দুই বছরে বয়সভিত্তিক ফুটবলে আমাদের ছোটখাটো কিছু সাফল্যের মিলিত যোগফলই। গত এক বছরে ভুটানে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে, তাজিকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দুর্দান্ত খেলেছে। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৬ দলও কাতারের মাটিতে কাতারকে হারানোর স্বাদ নিয়েছে। নতুন প্রজন্মের ফুটবলারদের ছোঁয়ায় বাংলাদেশের ফুটবলের বদলে যাওয়ার যে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে, সেটি ধরে রাখার দায়িত্ব এখন ফুটবল কর্তাব্যক্তিদেরই। বয়সভিত্তিক ফুটবলে বিনিয়োগ যে বৃথা যায় না, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ফুটবলাররা কাতারকে হারিয়ে সেটি কিন্তু প্রমাণ করেই দিয়েছে।

গতকালকের জয়টি তাই কেবল একটি সাফল্যই নয়, বাংলাদেশের ফুটবলের নতুন যাত্রার সূচনাও।

এশিয়াড ফুটবলে বাংলাদেশের চার জয়

ফল

বিপক্ষ

 

সাল

২-১

মালয়েশিয়া

 ১৯৮২

 

১-০

নেপাল

 

১৯৮৬

১-০

আফগানিস্তান

 ২০১৪

 

১-০

কাতার

 

২০১৮

প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমস ফুটবলের নকআউট পর্বে উঠেছে বাংলাদেশ

এশিয়াডে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দলের বিপক্ষে প্রথম জয় তো বটেই, পয়েন্টও এই প্রথম পেল বাংলাদেশ

ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে কাতার বাংলাদেশের চেয়ে ৯৬ ধাপ এগিয়ে। বাংলাদেশ ১৯৪, কাতার ৯৮

কাতারের বিপক্ষে তিন ম্যাচ খেলে তিনটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ জাতীয় দল

দ্বিতীয় রাউন্ডে বাংলাদেশ খেলবে ‘এফ’ গ্রুপের রানার্সআপ দলের বিপক্ষে। সৌদি আরব, ইরান, মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া-‘এফ’ গ্রুপের এই চার দলেরই কোনো একটি হবে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ