ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সেই ১০ মহারণ

১৯৮২ সালে ম্যারাডোনার সেই হতাশার ব্রাজিল ম্যাচ। ফাইল ছবি
১৯৮২ সালে ম্যারাডোনার সেই হতাশার ব্রাজিল ম্যাচ। ফাইল ছবি

ফুটবলে ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার লড়াই মানেই এক মহারণ। চরম উত্তেজনা আর ফুটবল–ভক্তদের দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া। আজ রাত ১২টায় এক প্রীতি ম্যাচে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি হলেও ব্রাজিল কোচ তিতে তো আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, এই দুই দলের লড়াইয়ে সত্যিকার অর্থেই ‘প্রীতি’র কিছু নেই। সৌদি আরবের জেদ্দায় এই দুই দলের ম্যাচে চোখ রাখার আগে ফিরে যাওয়া যেতে পারে অতীতে। ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার লড়াইয়ের ইতিহাসের ১০টি মুহূর্ত নস্টালজিয়ার পাশাপাশি ফুটবলপ্রেমীদের রক্তে নতুন করে ধরিয়ে দিতে পারে আগুন। নতুন করে তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন ১০৫ বছরের পুরোনো এই দ্বৈরথের নির্যাস।

ম্যারাডোনার হতাশা, ১৯৮
১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনা বাঁচা–মরার এক ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিলের। সেই ব্রাজিল ছিল জিকো, সক্রেটিসের ব্রাজিল। আর্জেন্টিনাও কম প্রতিভাবান ছিল না। ডিয়েগো ম্যারাডোনা তখন ফুটবল দুনিয়ায় মাত্রই রাজত্ব করা শুরু করেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের সে ম্যাচে প্রতিভাবান ম্যারাডোনাকে রুখতে কিছুটা বিতর্কিত কৌশল গ্রহণ করেছিল ব্রাজিল। ফাউলের পর ফাউল করে ম্যারাডোনাকে ত্যক্ত–বিরক্ত করে তুলেছিল ব্রাজিলীয় রক্ষণ। কিছুটা নেতিবাচক কৌশল অবলম্বন করেও ব্রাজিল ম্যাচে এগিয়ে গেল ৩–০ গোল। দেশ বিদায় নিচ্ছে, তিনি কিছুই করতে পারছেন না। হতাশায় ম্যারাডোনা সে ম্যাচে কী করলেন?  লাথি মেরে বসলেন প্রতিপক্ষের বাতিস্তাকে। খেলা শেষ হওয়ার ৫ মিনিট বাকি থাকতে ম্যারাডোনার সেই আচরণ সহ্য করেননি রেফারি। সঙ্গে সঙ্গে লাল কার্ড দেখানো হয় তাঁকে।

১৯৯০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে একাই লড়েছিলেন ম্যারাডোনা। ফাইল ছবি
১৯৯০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে একাই লড়েছিলেন ম্যারাডোনা। ফাইল ছবি


ম্যারাডোনা–ক্যানিজিয়ার যুগলবন্দী, ১৯৯০
১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপে আবারও দ্বিতীয় রাউন্ডে মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। কারেকা, অ্যালেমাও, দুঙ্গা, ব্রাঙ্কো, মুলারদের ব্রাজিল কিছুটা ছন্নছাড়া ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার সঙ্গে খেলাটিকে প্রায় একতরফাই বানিয়ে ছেড়েছিল। একের পর এক সুযোগ নষ্ট করে ব্রাজিলীয় দল যখন দিশেহারা, হতাশ, ঠিক সে সময়ই প্রায় একক প্রচেষ্টায় একটি বল মধ্যমাঠ থেকে বের করেন ম্যারাডোনা। চার ব্রাজিলীয় রক্ষণসেনাকে ফাঁকি দিয়ে প্রায় ফাঁকায় ঠেলে দেন ক্লদিও ক্যানিজিয়াকে। ব্যস, ক্যানিজিয়ার ওই এক গোলেই নব্বইয়ের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায়ঘণ্টা বেজে যায় ব্রাজিলের।

৫ লাল কার্ডের ম্যাচে নায়ক বাতিস্তুতা, ১৯৯১
কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টের ম্যাচ ছিল সেটি। সান্তিয়াগোতে দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ সে ম্যাচটি আগুন ছড়িয়েছিল। দুই দলের খেলোয়াড়েরা এত বেশি উত্তেজিত ছিলেন যে রেফারিকে সেদিন খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পাঁচটি লাল কার্ড দেখাতে হয়েছিল। তবে সে ম্যাচে শেষ হাসি হেসেছিল আর্জেন্টিনাই। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার অসাধারণ এক গোলে ৩–২ গোলে ম্যাচ জেতে আর্জেন্টিনা। পরে আর্জেন্টিনাই সেবারের কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্ট জিতে নেয়।

হ্যান্ডবল বিতর্কে ব্রাজিলের জয়, ১৯৯৫
১৯৯৫ সালের কোপাতেও আর্জেন্টিনা ছিল ফেবারিট। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় তারা। হাড্ডাহাড্ডি এই লড়াই কিছুটা বিতর্কের ছায়ায় ঢাকা। ১–০ গোলে পিছিয়ে থাকা খেলায় ৮১ মিনিটে সমতায় ফেরে ব্রাজিল। তুলিও মারাভিলহা যে গোলটি করেন, সেটিই ছিল বিতর্কিত। ডান প্রান্ত থেকে আসা একটি ক্রস নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সময় মারাভিলহা হাত দিয়ে বল ধরেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। তবে রেফারির চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল সেটি। ১–১ গোলে সমতার সেই ম্যাচটাই টাইব্রেকারে নিজেদের করে নিয়েছিল ব্রাজিল।

ব্রাজিলের মাটিতে আর্জেন্টিনার শেষ জয়, ১৯৯৮
আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা এই ম্যাচটিকে একটু বিশেষ জায়গায় রাখবেন, কারণ ব্রাজিলের মাটিতে সেটি যে ছিল আর্জেন্টিনার শেষ জয়। ক্লদিও লোপেজের মুহূর্তের ঝলকে মারাকানার সে ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের জন্য। গোলশূন্যভাবে এগিয়ে চল ম্যাচের একপর্যায়ে বাঁ প্রান্ত থেকে একটি বল ধরে লোপেজ ব্রাজিলীয় রক্ষণসেনা জুনিয়র বাইয়ানোকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে।

২০০৪ সালে আদ্রিয়ানো আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়েছিলেন। ফাইল ছবি
২০০৪ সালে আদ্রিয়ানো আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়েছিলেন। ফাইল ছবি


আদ্রিয়ানোয় আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গ, ২০০৪
১৯৯৩ সালের পর আরও একটি কোপা আমেরিকা ট্রফির কাছাকাছিই পৌঁছে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে কিলি গঞ্জালেজের গোলে এগিয়েও ছিল তারা। কিন্তু ৮৭ মিনিটে ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার আদ্রিয়ানো স্বপ্নভঙ্গ ঘটান আর্জেন্টিনার। সমতা ফিরিয়ে ম্যাচটি টাইব্রেকারে নেন। পরে অবশ্য ম্যাচটা টাইব্রেকারে জিতে কোপার আরও একটি শিরোপা নিজেদের করে নয় ব্রাজিল।

হার্নান ক্রেসপোর জাদু, ২০০৫
লাতিন অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ ছিল এটি। এই শতকের শুরুর দিকে ব্রাজিল যেমন ফুটবল দুনিয়ায় নিজেদের একটি শক্তিশালী দল হিসেবে পরিচিত করেছিল, ঠিক তেমনি তাদের বড় চ্যালেঞ্জ কিন্তু ছুঁড়েছিল ভেরন, ক্রেসপোদের আর্জেন্টিনা। ২০০৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঠিক এভাবেই নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছিল আর্জেন্টিনা। হার্নান ক্রেসপোন জোড়া গোল আর হুয়ান রোমান রিকেলমের গোলে আর্জেন্টিনা ৩–১ গোলে হারায় ব্রাজিলকে। ব্রাজিলের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন রবার্তো কার্লোস।

রোনালদিনহো আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল করেছিলেন ২০০৫ সালে। ফাইল ছবি
রোনালদিনহো আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল করেছিলেন ২০০৫ সালে। ফাইল ছবি


কনফেডারেশনস কাপে ব্রাজিল শো, ২০০৫
কনফেডারেশনস কাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে রীতিমতো উড়িয়েই দিয়েছিল ব্রাজিল। রোনালদিনহো–কাকাদের ওপর যেন সেদিন ঐশ্বরিক কিছু ভর করেছিল। তারা যা করতে চাচ্ছিলেন, করতে পারছিলেন সেটিই। ম্যাচের ১৬ মিনিটের মধ্যেই কাকা ও আদ্রিয়ানোর গোলে ২–০ গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। এরপর রোনালদিনহোর ৪৭ মিনিটের গোল আর ৬৩ মিনিটে করা আদ্রিয়ানোর আরও একটি গোলে ৪–০ গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। শোচনীয় হারের মুখে ব্রাজিলকে সেদিন একটি গোল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার পাবলো আইমার।


মেসি–যুগের শুরুতেই আর্জেন্টিনার বিপর্যয় ২০০৭
লিওনেল মেসি তখন আর্জেন্টিনা দলে চলে এসেছেন। কিন্তু কোপা আমেরিকা প্রতিযোগিতার ফাইনালে ব্রাজিলের হাতে ভালো নাকাল হয় আর্জেন্টিনা। ম্যাচ হারে ৩–০ গোলে। প্রথমে ৪ মিনিটের মাথায় ব্যাপতিস্তার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। সেই ‘এগিয়ে থাকা’কে ম্যাচ জয়ে পরিণত করেন দানি আলভেজ ও আয়ালা। কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের হাতে আরও একবার স্বপ্নভঙ্গ হয় আর্জেন্টিনার।


ব্রাজিল দেখল মেসি–জাদু ২০১২
ম্যাচটা কিন্তু মোটেও একপেশে ছিল না। ২০১২ সালের প্রীতি ম্যাচটিতে আর্জেন্টিনা জেতে ৪–৩ গোলে। লিওনেল মেসি হ্যাটট্রিক করে নিজের জাত চেনান ব্রাজিলকে। আর্জেন্টিনার অপর গোলটি ফার্নান্দেজের। ব্রাজিলের পক্ষে গোল তিনটি হাল্ক, রোমুলো ও অস্কারের। স্কোরলাইন ৩–৩ থাকা অবস্থায় ৮৫ মিনিটে নিজের হ্যাটট্রিক পূরণ করেন মেসি। জয়ও নিশ্চিত হয় আর্জেন্টিনার।