ক্রিকেট শুধু ব্যাট-বলের নয়, মনের খেলাও

ক্রিকেটে সাফল্য পেতে মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজন। ছবি: প্রথম আলো
ক্রিকেটে সাফল্য পেতে মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজন। ছবি: প্রথম আলো
>

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পাঁচজন মনোবিদ কাজ করেছেন। ক্রিকেটাররা সুফলও পেয়েছেন তাতে।

প্রথম বলটাই শর্ট। ধেয়ে আসছে বাউন্সার। ঘাড়ের পেছনে একটা দপদপানি টের পেলেন তামিম ইকবাল। তির তির করে কেঁপে উঠল শিরা। ঠোঁটে স্মিত হাসি। এই তো চাই!

একমুহূর্ত দেরি না করে পুল। ব্যাট-বলের শব্দ শুনেই বুঝলেন কী হতে যাচ্ছে। ডিপ স্কয়ার লেগের ওপারে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করলেন না। তামিম যেন চোখ বন্ধ করেই দেখে ফেললেন গ্যালারিতে বল নিয়ে দর্শকদের কাড়াকাড়ি। এ রকম ছক্কা তো জীবনে কম মারেননি!

যখন চোখ খুললেন, তামিম হয়তো নিজেকে আবিষ্কার করেন বসার ঘরে কালো রঙের বিশাল সোফায়। এরপর বিছানায় গিয়ে লম্বা ঘুম। সকালে ম্যাচ, তার আগে ভালো ঘুমটা খুব জরুরি।

এ রকম তামিমের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে থাকতে পারে, ঘটতে পারে মুশফিকুর রহিম কিংবা অন্য কারও ক্ষেত্রেও। কল্পনায় নিজেকে অসীম ক্ষমতাবান ভাবা। ভাবা, শেষ বলে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরছেন বীর বেশে। অথবা খেলাটাকে সহজ করে নিতে ম্যাচের প্রথম বলেই ছক্কার অগ্রিম ছবি এঁকে রাখা। মাঠে গিয়ে তখন এই উপলব্ধি আসতে পারে, ‘আরে ছক্কা! সে তো কাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও একটা মারলাম!’ ভালো কিছু করার দৃশ্য অগ্রিম ভেবে রাখলে মানসিক প্রস্তুতিটা ভালো হয়। বাকি থাকে কেবল মাঠে কাজটা করা। ক্রীড়া মনোবিজ্ঞান বলে, এমন কল্পনা মাঠে সাহসের অনুঘটক হয়। আবার পুরোনো কোনো ভালো স্মৃতির রোমন্থনও হতে পারে ফিরে আসার প্রেরণা।

২০০৩ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে সাত-আট দিন কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ান এক মনোবিদ। কয়েক বছর পর বেশ কিছুদিনই বাংলাদেশ দলের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশি মনোবিদ সালাহউদ্দিন কাওসার (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান)। ২০১১ বিশ্বকাপের সময় মাস দেড়েক ছিলেন ভারতীয় বাঙালি সৌমেন্দ্র সাহা। ২০১৪ সালে টানা হারের দুঃসময়ের পর আসেন কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি আলী আজহার খান। ২০১৫-এর বিশ্বকাপ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চারটি সিরিজে দলের সঙ্গে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ফিল জনসি। এবার জিম্বাবুয়ে সিরিজেও ক্রিকেটাররা মনের দুয়ার খুলে দিতে পাচ্ছেন একজন মনোবিদ। এক সপ্তাহের জন্য আবার আসছেন আজহার আলী খান। একেক সময়ে একেক পরিস্থিতিতে ডাক পড়ে মনোবিদের। এবার যেমন আনা হচ্ছে স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচে স্নায়ু জয় করার উপায় খুঁজতে। গত কিছুদিনে এমন ম্যাচ যে বেশ কয়েকটিই হেরেছে বাংলাদেশ!

এর আগে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের কারও পরিচয় মনোবিদ, কেউ নামের সঙ্গে লাগাতে পছন্দ করেন ক্রীড়া মনোবিদ, আবার কেউবা ‘লাইফ সাকসেস কোচ’। কিন্তু কাজটা ঘুরেফিরে একই। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। মানসিক ক্লান্তি, অবসাদ আর দুঃসময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের কৌশল শেখানো। কোনো ক্রিকেটার সেটা আত্মস্থ করতে পারেন, কেউ পারেন না। কারও মনে হয়, ‘আমার তো এসব লাগেই না।’ কিন্তু সবকিছুর পর মনোবিদ-শরণে ইতিবাচক প্রভাবই পড়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে।

জনসির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা আলাদা করে বললেন মাহমুদউল্লাহ, ‘ওনার সঙ্গে সেশনগুলো আমার দারুণ কাজে লেগেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি।’ ব্যক্তিগতভাবে তিনি কাজ করেছেন আজহার আলীর সঙ্গেও। ক্রিকেটারদের বেশির ভাগ বিকেএসপির এই সাবেক ছাত্রের সঙ্গেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তামিম, মুশফিক, ইমরুল ও মুমিনুলও বাড়তি টাকা খরচ করে তাঁর সঙ্গে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ সেশন করেছেন। মুঠোফোনে কথা বলেন ঢাকা থেকে কানাডা। তাতেই সেরে যায় মনের রোগ।

ইমরুল বলছিলেন, ‘খারাপ সময়ে খেলোয়াড়দের মনে নেতিবাচক চিন্তা আসে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যার কারণেও অনেক সময় মানসিক অবসাদ বা বিষণ্নতা আসে, যার প্রভাব খেলায় পড়ে। তাঁদের কথা শুনলে সমস্যাগুলো দূর হয়। ওনারা সমস্যাটা ধরিয়ে দেন এবং তা থেকে বের হওয়ার কৌশল শিখিয়ে দেন।’

মনোবিদের ওপর খেলোয়াড়ের আস্থা থাকলেই কাজ করে এসব কৌশল, সমস্যা নিয়ে তাঁর সামনে খোলা বইয়ের মতো যেতে হয়। মাহমুদউল্লাহর পরামর্শ, ‘সবার আগে বুঝতে হবে, আমি এটা চাই কি না বা আমি আসলে তাঁর কাছ থেকে কী চাই। আমি যদি মন থেকে জিনিসটা না চাই, তাহলে কোনো মনোবিদের পক্ষেই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।’

মনোবিদের সাহায্য নিয়ে সুফল পাওয়া আরেক ক্রিকেটার মুশফিকের মত, ‘দলের সবাইকে নিয়ে বসলে খোলা মনে সব বলা যায় না। একজন একজন করে বসলে ভালো। তখন সবকিছু নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা যায়।’

মনোবিদ না হয়েও ক্রিকেটারদের মনের খবর রাখেন বিসিবির সাবেক ন্যাশনাল গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার ও বর্তমানে মহিলা উইংয়ের ম্যানেজার নাজমুল আবেদীন। মনোবিদের উপকারিতা তিনিও দেখেন। তবে তাঁর মত, ‘সাধারণ মনোবিদ আর খেলার মনোবিদ এক নয়। ক্রিকেটারদের মন নিয়ে যে কাজ করবে, তাঁর ক্রিকেটটা জানা জরুরি।’ দুই-চার-ছয় দিনের জন্য কাউকে না এনে ফিজিও, ট্রেনারের মতোই দলের সঙ্গে নিয়মিত মনোবিদ রাখার পক্ষে তিনি। তাতে সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়া সম্ভব।

২০০৩ বিশ্বকাপ-পূর্ব অভিজ্ঞতায় সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারেরও তাই মনে হয়েছিল, ‘উনি সপ্তাহখানেক কাজ করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে কিছু কৌশল শিখেছিলাম। কিন্তু সেগুলো পরে আমরা সেভাবে চর্চা করিনি। আমার মনে হয় মনোবিদ রাখা উচিত লম্বা সময়ের জন্য। তাতে খেলোয়াড়দের সমস্যাগুলো তিনি ধরতে পারবেন, খেলোয়াড়েরাও পারবে তাদের প্রয়োজনে সাহায্য নিতে।’

উল্টোটাও আছে। ‘বিরক্তিকর’ কথাবার্তার কারণে সাবেক এক মনোবিদের কাছ থেকে পালাতে চাইতেন ক্রিকেটাররা। ব্যাপারটা তাই দ্বিমুখী। মনোবিদকে যেমন খেলোয়াড়দের মন বুঝতে হয়, খেলোয়াড়দেরও তাঁর কাছে উন্মুক্ত হওয়ার মন থাকতে হবে।
মনের চেয়ে বড় মনোবিদ আর কে আছে!