ঢালাইকর থেকে অফিস বয়, তারপর শতাব্দীর সেরা!

মোহাম্মদ আব্বাস। যেতে হবে বহুদূর। ছবি: এএফপি
মোহাম্মদ আব্বাস। যেতে হবে বহুদূর। ছবি: এএফপি
>গত ১০০ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে ন্যূনতম ৫০ উইকেট পেয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে মোহাম্মদ আব্বাসের বোলিং গড় সেরা

মোহাম্মদ আব্বাস এখন রূপকথার গল্প বিশ্বাস করতেই পারেন। তাঁর নিজের গল্পটা যে রূপকথার চেয়ে কোনো অংশে কম না!

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ঝাটকি গ্রামে জন্ম আব্বাসের। আর দশজন গ্রামের সাধারণ ছেলের মতোই খেলাটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু যা হয় আর কি, ক্রিকেটার হিসেবে নিজের জীবন গড়ে তুলতে ছোটবেলা থেকেই মুখোমুখি হয়েছিলেন বাধার। বড় সন্তান বলে কথা! পরিবারের দায়িত্ব তো নিতে হবে। আব্বাস সেই দায়িত্ব পালনের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে মিটিয়েছেন নিজের হৃদয়ের দাবিও। বয়সভিত্তিক দলের ধাপগুলো পেরিয়ে এরই ধারাবাহিকতায় ২৮ বছর বয়সী এই পেসার এখন পাকিস্তান বোলিং আক্রমণের অন্যতম ভরসা। সর্বশেষ আবুধাবি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তানের জয়ে তাঁর অবদান ১০ উইকেট!

তবে আব্বাসের ক্যারিয়ারের শুরুতে কোনো ভরসা ছিল না। তাঁর কথায় ‘জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নটা তখন ছিল না’। সেই সময়টা কখন? আব্বাস যখন দুরন্ত কিশোর। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে পরিবারকে সাহায্য করতে কাজ নিয়েছিলেন চামড়ার কারখানায়। ঢালাইকর হিসেবে। এরপর ভূমি অধিদপ্তরের অধীনে আদালতে জমি নিবন্ধন কার্যালয়ে অফিস বয়ের কাজও করেছেন আব্বাস। এই কাজে থাকতে নিজ জেলার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান তিনি। কিন্তু আব্বাসকে বলা হয়েছিল, অফিসের কাজ আর ক্রিকেটের মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নিতে। সেই রাতের কথা আব্বাস কখনো ভুলতে পারেননি। তাঁর এক আইনজীবী বন্ধুর মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত দুই কূলই রক্ষা হয়।

সেই অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে খেলার সময় আরেকটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন আব্বাস। সচিবের ছেলে অথবা তিনি—এই দুইয়ের মধ্যে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে হতো দলকে। শেষ পর্যন্ত টস করে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল আর সেই টসভাগ্যে কে জিতেছিল তা বলাই বাহুল্য। আব্বাসের ভাষায়, ‘ভাগ্যটা আমার পক্ষে ছিল এবং সেই ম্যাচে আমি ৫ উইকেট পেয়েছিলাম। এরপর আঞ্চলিক দলে সুযোগ পাই এবং আর পেছনে তাকাতে হয়নি।’

আব্বাসের দৃষ্টি এখন শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার। গত বছর টেস্ট অভিষেকের পর এই সংস্করণে ১০ ম্যাচে তাঁর উইকেটসংখ্যা ৫৯। গড় ১৫.৬৪! অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে তাঁর উইকেটসংখ্যাই সর্বোচ্চ—১৭। কোনো সিরিজে কমপক্ষে ১৫ উইকেট পেয়েছেন এমন পারফরম্যান্স করা পাকিস্তানি বোলারদের মধ্যে আব্বাসের গড়ই সবচেয়ে ভালো—১০.৫৮। তবে টেস্ট আঙিনায় এ কদিনের পথচলায় আব্বাস এমন এক কীর্তি গড়েছেন যা এই সংস্করণে গত ১০০ বছরের মধ্যে সেরা!

টেস্ট ক্রিকেটে ন্যূনতম ৫০ উইকেট পেয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে গত এক শতাব্দীতে আব্বাসের বোলিং গড়ই সেরা—১৫.৬৪। আর সব কাল বিবেচনায় চতুর্থ সেরা।

১০ ম্যাচে ১৯ ইনিংসে বল করেছেন আব্বাস। ২২৪৪টি বৈধ ডেলিভারিতে ৯২৩ রান খরচায় তাঁর উইকেটসংখ্যা ৫৯। ১৭.৯৭ বোলিং গড় নিয়ে গত ১০০ বছরের এই তালিকায় দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ার বাঁ হাতি স্পিনার বার্ট আয়রনমঙ্গার। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি পেসার ফ্রাঙ্ক টাইসনের বোলিং গড় ১৮.৫৬—তিনি এই তালিকায় তৃতীয়। আয়রনমঙ্গার ও টাইসনের ক্যারিয়ার যথাক্রমে ১৪ ও ১৭ টেস্টের। আব্বাসের ক্যারিয়ার এখনো পড়ে আছে। সময়ের সঙ্গে ম্যাচসংখ্যা বাড়লে তাঁর বোলিং গড়েও যে পরিবর্তন আসবে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তার আগে টেস্ট আঙিনায় কজনের এমন স্বপ্নের শুরু হয়! কজন এত প্রতিকূলতা পেরিয়ে স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছেন!

সেটিও আবার অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে দারুণ পারফর্ম করে। আরব-আমিরাতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে আব্বাস যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন তা জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসে। গত ১০০ বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোনো সিরিজে পেসারদের মধ্যে আব্বাসের বোলিং গড়ই সেরা (১০.৫৮)।

চামড়ার কারখানায় ঢালাইকর থেকে অফিস বয় ; এই সংগ্রামের পাশাপাশি শুধু ক্রিকেটটা খেলেছিলেন বলে আজ তিনি পাকিস্তান জাতীয় দলে। আর দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আব্বাসের এসব কীর্তি কী বলে? তাঁর উঠে আসার গল্পটা রূপকথার চেয়ে কোনো অংশ কম নয়!