২০১১ বিশ্বকাপে যেভাবে গড়াপেটার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল...

হামজা তারিক। ছবি: টুইটার
হামজা তারিক। ছবি: টুইটার
>হামজা তারিক—২৮ বছর বয়সী কানাডার উইকেটরক্ষক। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) খেলেছেন কানাডার একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে। ২০১১ বিশ্বকাপে ২০ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিন ব্যক্তি—যাঁদের সঙ্গে বাজিকরদের যোগাযোগ ছিল। ক্রিকইনফোকে সেই ঘটনা খুলে বলেছেন হামজা তারিক। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তা তারিকের জবানিতে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো

২০১১ বিশ্বকাপে আমিই সম্ভবত সর্বশেষ ক্রিকেটার যাকে দুর্নীতির সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন আমি কুড়ি বছর বয়সী। আগের বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছি, কানাডা দলেও জায়গা পাকা হয়নি। কখনো ভাবিনি কানাডার কোনো ক্রিকেটারকে এমন কোনো প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। কিংবা ঘটলেও সেটি পাবেন কোনো তারকা খেলোয়াড়, আমার মতো রিজার্ভ খেলোয়াড় না। কিন্তু আদতে সেটাই ঘটেছিল।

কথাটা (বুকিদের যোগাযোগ) জানানোর পর সবার প্রথম প্রশ্ন ছিল ‘কত টাকা দেওয়ার প্রস্তাব?’। কেউ পুরো ঘটনাটা শুনতে চায়নি—কীভাবে জড়ালাম, কীভাবে বের হয়ে আসলাম। এসব ব্যাপারে অনেক খেলোয়াড়ই ভুল করে। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার পর হাম্বানটোটায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছি। এ দুই ম্যাচে কিছুই ঘটেনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচটি খেলতে নাগপুরে যাই। সেখানে প্রথমবারের মতো ‘রাঘব’ নামে এক ক্রিকেটারের সঙ্গে পরিচিত হই।

২০১০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভারতে ১০টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল কানাডা। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত (আমি নিজেও) বেশির ভাগ খেলোয়াড় ভিসা জটিলতার কারণে সেই সফরে যেতে পারেনি। রাঘব নিজেও নাগপুরের বাসিন্দা। সেই সফরে একটি প্রতিপক্ষ দলের হয়ে সে খেলেছিল এবং আমাদের দলের অনেকের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নাগপুরে জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি হওয়ার আগে আমরা সাত দিন সময় পেয়েছিলাম। এক রাতে রাঘব আমি এবং আমার দুই সতীর্থকে হোটেলের পানশালায় পানীয়ের প্রস্তাব দেয়। পরে ক্লাবে যাওয়ার কথাও বলে। আমি রাজি হইনি। সে বলেছিল, ‘পানীয় আমি খাওয়াব। তোমাদের যথেষ্ট খাতির করা হবে।’ সে আমাদের খুব সম্মান করত আর নিজেও ছিল ক্রিকেটার। তাই আমাদের কথাবার্তায় অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

পরের দুটি ম্যাচে আমরা হেরে যাই। কেনিয়ার বিপক্ষে চতুর্থ ম্যাচ খেলতে ফিরে আসি ভারতে। ৬ মার্চ—ম্যাচের আগের দিন রাতে এক সতীর্থ এসে বলল, ‘তিন বয়স্ক (আংকেল) ব্যক্তিকে নিয়ে রাঘব আসছে। তাঁরা আমাদের নৈশভোজে নিয়ে যেতে চায়। তাঁদের হোটেল কামরায় আসতে বলেছি।’ আমি কোনো অসুবিধা দেখিনি। তাঁরা আধঘণ্টার মধ্যে চলে এল। প্রথম ব্যক্তিটির নাম ছিল সুনীল। দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম মনে নেই। তবে বলেছিল, হায়দরাবাদে তাঁর একটি ক্রিকেট একাডেমি আছে। আর তৃতীয় ব্যক্তিটি প্রায় কোনো কথাই বলেনি।

কথাবার্তার একপর্যায়ে তাঁরা একটি প্রশ্ন করেছিল—যা নিয়ে এখন ভাবি কিন্তু তখন মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। ‘তুমি কি আগামীকাল একাদশে থাকবে?’—তাঁদের জিজ্ঞাসা। বললাম, ‘না, আমি রিজার্ভ খেলোয়াড়। অধিনায়ক চোট পেলেই কেবল খেলব কারণ আমিও উইকেটরক্ষক।’ এরপর আমরা দুই সতীর্থ ও রাঘবকে নিয়ে নৈশভোজে যাই। সেখানে সেই তিন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা খুব সমাদর করেন। আমরাও হাসিমুখে বুঝে নেই যে, এই শহরে তাঁরা আমাদের আতিথ্য দিচ্ছেন কেবল। সেখানে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় কাটানোর পর আমার দুই সতীর্থ রাঘবের সঙ্গে হোটেলে ফিরে যায়। আর আমি পান খাওয়ার জন্য দেরি করি তাই আরেকটি ট্যাক্সিতে সেই তিন ব্যক্তির সঙ্গে রওনা দিই।

ট্যাক্সিতে আসার সময় তারা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিল, কাল একাদশে কে কে থাকছে? অনেকটা এভাবে, ‘কাল কারা খেলবে বলে ভাবছ?’ বলেছি, ‘আমি তো জুনিয়র সদস্য। কোনো ধারণা নেই।’ এ সময় তারা আমার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করল দলে ফিরবই। হোটেলে ফেরার সময় লোকগুলো জানাল, তারা কিছুক্ষণ পর ফোন করবে। আর হোটেলে ঢোকার সময় কোট পরা ব্যক্তি আমার ছবি তুলেছে। ভেবেছি সাংবাদিক গোছের কেউ হবে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর সাড়ে দশটার দিকে সুনীল ফোন করে আমাকে লবিতে আসতে বলল। সেখানে যাওয়ার পর দেখলাম সুনীলের সঙ্গে সেই তৃতীয় ব্যক্তি (যে প্রায় কোনো কথাই বলেনি) আর ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী একটি মেয়ে। ভীষণ সুন্দরী। তারা বলল, ‘মেয়েটাকে তোমার কামরায় নিয়ে যাও। কালকের পর যখন তোমরা মুম্বাইয়ে যাবে খেলতে (১৩ মার্চ—নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) তখন সে তোমার সঙ্গে প্রায় পুরো সপ্তাহই থাকবে। আমরা সবকিছু দেখাশোনা করব।’

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার টনক নড়ল। তাদের সঙ্গে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচয়। এরই মধ্যে তারা আমাকে মেয়ে সাধছে! ট্যাক্সিতে যে প্রশ্নগুলো করেছিল, সেগুলোও ঘাই মারল মনের মধ্যে। কিন্তু তখনো পুরোপুরি ভাবিনি যে ওরা বাজিকর কিংবা খারাপ লোক হতে পারে। একটা প্রস্তাব দিয়েছে—সেটিতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলাটা আমার ইচ্ছা। আমি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করলাম। বললাম, ‘এসব ভালো লাগছে না। প্রস্তাবটির জন্য ধন্যবাদ কিন্তু আমার ইচ্ছে নেই।’ কিন্তু ওরা দমবার পাত্র নয়। বলল, আমার হোটেল কামরার ফ্লোরের পেছনে একটি সিঁড়ি আছে। ভীত কিংবা কোনো কিছু নিয়ে শঙ্কা জাগলে সেদিক দিয়ে নামা যেতে পারে। এ ছাড়াও ওরা আমাকে আলাদা একটি হোটেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি বললাম, ‘না, ঠিক আছে। প্রস্তাবটির জন্য ধন্যবাদ তবে এসব ভালো লাগে না।’

দশ মিনিট পর আবারও লবিতে নামি কানাডায় পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তখন আরেকটি লোক আমার সঙ্গে কথা বলে যাঁকে ধুরন্ধর বলেই মনে হয়েছে। সে জানাল, ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম লাগলে তারা সরবরাহ করবে। এরই মধ্যে সেই কোট পরা লোকটাকে দেখলাম কাছাকাছি বসে আছে। খুব কাছে নয়, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সে আমাকে অনুসরণ করছিল। একপর্যায়ে আমি অভ্যর্থনা কক্ষে যোগাযোগ করে নজর রাখার ব্যাপারটা জানাই। সেই লোকটাও অভ্যর্থনা কক্ষে গিয়ে জানতে চায়, কী কথা বলেছি। এবার তাঁকে সরাসরি ধরলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘নৈশভোজ থেকে ফেরার সময় ছবি তুলতে দেখেছি। কে তুমি?’

আমি যে কানাডার খেলোয়াড় সে তা জানে। এই কথা আমাকে জানিয়ে বলল, এত দেরি করে আমার কামরায় যাওয়ার ব্যাপারটা তাঁকে অবাক করেছে। এরপর সে জানাল, আইসিসি দুর্নীতি দমন ইউনিটের (এসিইউ) সঙ্গে আছে। এরপরই আমি ভয় পেয়ে যাই। সে সোজাসাপ্টা বলল, বিছানায় যাও। পরদিন দুপুরে ম্যাচ খেলতে যাওয়ার বাস ধরতে লবিতে নামলাম। সেখানে আইসিসি দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমাদের জানালেন, এই ম্যাচটা (কেনিয়ার বিপক্ষে) নিয়ে প্রচুর মেইল ও খুদে বার্তা এসেছে। খেলোয়াড়েরা এ নিয়ে কিছু জানাতে চাইলে তা ম্যাচের আগে বলাই ভালো।’

এরপর আমি সেই কর্মকর্তাকে ক্রিকেট সরঞ্জাম সরবরাহের প্রস্তাব দেওয়া লোকটার কথা জানাই। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে গা-গরমের সময় সেই তিন লোকের ব্যাপারেও মনে মনে সন্দেহ হয়। আমি টিম ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কর্মকর্তাকে ডাকি। সেই কর্মকর্তা এসে জানালেন, আমি যে তাঁকে ডাকব তিনি জানতেন। আমি রাঘব এবং সেই তিন লোকের ব্যাপারে সবিস্তারে জানাই। তিনি প্রশ্ন করলেন, ওরা কোথায় উঠেছে তুমি জান?’ বললাম, রাস্তারই পাশের এক হোটেলে।’ কর্মকর্তাটি জানালেন, ‘না, ওরা তোমাদের হোটেলেই উঠেছে।’ তখন বুঝলাম, কিছু একটা গড়বড় আছে।

এসিইউ কর্মকর্তা সেই তিন লোককে ফোন করতে বললেন। আমি বললাম, ‘আমার ফোন নিয়ে আপনি যাকে খুশি তাকে ফোন করতে পারেন। আমি এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাই না।’ কিন্তু তাঁর দাবি, ‘যেহেতু তোমার সঙ্গে যোগাযোগ তুমি ফোন করো।’ যুক্তি দিলাম, ‘এখন ফোন করলে ওরা বুঝে যাবে কোনো সমস্যা আছে। কারণ আমি প্রস্তাবে রাজি হইনি। তা ছাড়া খেলার মাঠেও আমার ফোন নিয়ে আসার কথা নয়।’ কর্মকর্তা বললেন, ‘একটা পথ খুঁজে বের করো।’

আমরা স্টেডিয়ামের বাইরে গেলাম এবং সুনীলকে ফোন দিলাম। ধরল রাঘব। বললাম সুনীলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। একটা কথা বলতে চাই। সুনীল ধরলে আমি বললাম, ‘যে লোকটা সেদিন একটা মেয়ে নিয়ে এসেছিল তাঁর ফোন নম্বরটা দাও। আজ রাতে মেয়েটাকে লাগবে।’ সুনীল বলল, ‘এ জন্য আমাকে ফোন করেছ? তোমার তো এখন মাঠে থাকার কথা?’ আমি বললাম, দেরি করে ঘুম থেকে ওঠায় বাস মিস করেছি। এখন হোটেল লবিতে দাঁড়িয়ে আছি ট্যাক্সির জন্য। সুনীল বলল, ‘সমস্যা নেই, ম্যাচ শেষে ফোন করো।’ ফোনের স্পিকারে তখন এসিইউ কর্মকর্তা সব শুনেছে। সুনীল জিজ্ঞেস করল, ‘আজ ওপেন করছে কে কে?’ বললাম, ‘জানি না।’

এরপর সুনীল আরেকটি সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কি মনে করো, কেনিয়াকে হারানোর মতো তোমরা যথেষ্ট শক্তিশালী? আমি কি কিছু টাকা বাজি ধরব?’ আমরা হিন্দিতে কথা বলেছি। সে বলেছে, ‘প্যায়সা লাগা দুঁ?’ আমি বলেছি, ‘জানি না। তোমার টাকা, যা খুশি করো।’ এরপর সে ম্যাচ শেষে ফোন করতে বলল। কেনিয়াকে ৫ উইকেটে হারানোর পর হোটেলে ফেরার সময় সেই কর্মকর্তা সুনীলকে আবারও ফোন করতে বললেন। ফোন করে সুনীলকে বললাম মেয়ের ব্যাপারে। সুনীল বলল, কিছুক্ষণ পর ফোন দিচ্ছি। লবিতে আমরা সতীর্থদের সঙ্গে জয় উদযাপন করলাম। প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় কেটে গেল কিন্তু সুনীল ফোন করেনি। এসিইউ কর্মকর্তা আবারও তাঁকে ফোন দিতে বললেন। সুনীল ফোন ধরে জানাল, ‘মন্দিরে আছি। পরে ফোন দিচ্ছি।’ সে আমাকে আর কিছুই বলার সুযোগ দেয়নি। এরপর আর তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি।

ভীষণ হতাশ হয়ে এসিইউ কর্মকর্তাকে বললাম, ‘তোমাকে সব বলেছি। আমি আর কিছুই জানি না। তুমি চাইলে আমার ফোন নিতে পার। কিন্তু আমাকে দলের সঙ্গে জয়টা উপভোগ করতে দাও।’ তিনি বললেন, ‘যাও, রাতটা উপভোগ করো।’ আমি সতীর্থদের সঙ্গে পানশালায় যাই এবং সেই বিশ্বকাপে আর কিছুই ঘটেনি।’