'ওকে আমরা বুলেট খালেদ বলি'

>আবু জায়েদ ও খালেদ আহমেদ—দুজনই পেস বোলার। দুজনের প্রিয় বোলার জেমস অ্যান্ডারসন। দুজনের সবচেয়ে বড় মিল—তাঁরা উঠে এসেছেন সিলেট থেকে। তাঁদের জন্মশহরেই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টেস্ট ম্যাচ। আর বাংলাদেশ দলে আছেন দুজনই। সিলেটের বৃষ্টিমুখর বিকেলে এক জায়গায় বসিয়ে আবু জায়েদ-খালেদের গল্প শুনলেন রানা আব্বাস

সকাল থেকেই সিলেটে বৃষ্টি। কখনো ঝমঝমিয়ে, কখনো টিপটিপ। সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবহনশ্রমিকদের ধর্মঘট। পুরো শহর যেন ঘুমিয়ে। যান্ত্রিক কোলাহল কিংবা নগরবাসীর ব্যস্ততা হঠাৎ যেন উধাও সবুজ শহরটা থেকে!

সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের ইনডোরে অনুশীলন শেষে দুই সিলেটি আবু জায়েদ-খালেদ আহমেদ। ছবি: রানা আব্বাস
সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের ইনডোরে অনুশীলন শেষে দুই সিলেটি আবু জায়েদ-খালেদ আহমেদ। ছবি: রানা আব্বাস

ব্যস্ত দেখা গেল শুধু বাংলাদেশ দলকে। অনুশীলন করতে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দল চলে এল বেলা দেড়টায়। বৃষ্টিবাধায় মাঠে অনুশীলনের সুযোগ নেই। খেলোয়াড়েরা নিজেদের ঝালিয়ে নিলেন ইনডোরে। ইনডোরে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই ব্যাটিং করেছেন। ব্যাটিং অনুশীলনে সবার শেষে এলেন আবু জায়েদ ও খালেদ আহমেদ। দুজনের বাড়ি সিলেটে। অনেক দিন পর বাংলাদেশ দলে একসঙ্গে সিলেটের দুই খেলোয়াড়কে দেখা গেল। সিলেটের মাঠে প্রথমবারের মতো টেস্ট হচ্ছে, আর সেটিতে যদি দুই ‘সিলোটি’কে একসঙ্গে দেখা যায়, তাহলে তো সিলেটবাসীর আনন্দের শেষ থাকবে না! আজ বিকেলে ইনডোরে অনুশীলন শেষে প্রথম আলোকে নিজেদের স্বপ্ন, আশা, ভাবনার কথা জানালেন আবু জায়েদ ও খালেদ আহমেদ।

* আবু জায়েদ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন। এবার টেস্ট দলে সবচেয়ে বড় চমক হয়ে এসেছেন খালেদ। খালেদ, আপনার এ পর্যন্ত আসার পেছনে বাংলাদেশের সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের একটা ভূমিকা আছে বলে শুনেছি। একটু বিস্তারিত বলবেন?

খালেদ: বাবুল স্যার (মিজানুর রহমান) আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে। নেটে আমার বোলিং দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। বললেন, কোথায় ছিলে এত দিন! গত অস্ট্রেলিয়া সিরিজে আমাকে চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন। নেটে বোলিংয়ের সুযোগ দিলেন। নির্বাচকদের বলে এইচপি দলেও দিলেন। এইচপির হয়ে ইংল্যান্ড সফরে গেলাম, ভালো করলাম। বিপিএল, বিসিএলের পর প্রিমিয়ার লিগের হয়ে আবার এইচপি। এবার মূলত পেস বোলিং ক্যাম্পে কাজ করেছি। এরপর ‘এ’ দলে খেললাম। ‘এ’ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ভালো করেছি। এশিয়া কাপের প্রাথমিক দলে ডাক পেলাম। বর্তমান কোচ স্টিভ রোডস আমার বোলিং দেখলেন। বললেন, তোমার ভালো উচ্চতা (৬ ফুট ২ ইঞ্চি) আছে। বৈচিত্র্য বাড়াও। নিজের প্রতি আরেকটু যত্ন নাও। গত মাসে খুলনায় বিসিবির এইচপির ম্যাচে ৪ উইকেট পেয়েছিলাম। সবশেষ জাতীয় লিগে রাজশাহীতে ভালো করলাম। ১০ উইকেট পেলাম। এবারের জাতীয় লিগে সিলেট প্রথম জয়ের দেখা পেল আর সেটিতে ভালো অবদান রাখতে পারায় ভীষণ ভালো লাগা কাজ করছিল। মাঠ থেকে বেরিয়েই খবর পেলাম, জাতীয় দলে ডাক পেয়েছি। আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল।

* বাংলাদেশ টেস্ট দলে সুযোগ পেয়ে কতটা অবাক হয়েছেন?

খালেদ: না, অবাক হইনি। গত কিছুদিনে যেভাবে খেলছিলাম, আশা ছিল একদিন সুযোগ আসবে। এইচপি, ‘এ’ দল, এনসিএল (জাতীয় লিগ), বিসিএলে (বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ) নিজেকে তৈরি করেছি। সামনে হয়তো আরও ভালো কিছু হবে।

* সিলেটের আরেকজন ক্রিকেটার এলেন জাতীয় দলে। আবু জায়েদ, আপনি কতটা খুশি? খালেদ পেসার হওয়ায় আপনার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী বেড়ে গেল, তাই না?

আবু জায়েদ: ওকে বলি, যত দিন তুই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবি না, তত দিন নিজেকে দুর্দান্ত ক্রিকেটার ভাবতে পারবি না। জাতীয় লিগে খেলার সময় ওকে বলছিলাম, তুই এলে অনেক ভালো হবে। জাতীয় দলে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারি না। তুই এলে সেটা বলতে পারব! আমাদের মতো দুই-তিনজন খেলোয়াড় যদি বাংলাদেশ দলে আসে, সিলেটের অনেক ক্রিকেটার অনুপ্রেরণা পাবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দলে খেলার স্বপ্ন দেখবে।

* আপনাদের দুজনের একটা মিল হচ্ছে, বাংলাদেশ দল সুযোগ পেতে পেতে একটু সময় লেগেছে । দুজনই প্রায় ২৫-২৬ বছর বয়সে সুযোগ পেলেন। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নটা নিজেদের মধ্যে কীভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন দীর্ঘদিন?

আবু জায়েদ: ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই স্বপ্ন দেখেছি, জাতীয় দলে খেলব। বিশ্বাস করেছি ভালো করলে একদিন না একদিন সুযোগ আসবে।

খালেদ: একটা সময় খারাপ লাগত। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলতে পারিনি। নিজেকে বুঝিয়েছি, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলিনি তাতে কী! পরিশ্রম করলে একটা সময় জাতীয় দলে সুযোগ পাব। শেষ পর্যন্ত সুযোগটা পেয়েছি।

* দুজনের বোলিংয়ের মূল্য বৈশিষ্ট্য জানতে চাই। বোলিংয়ে কোন বিষয়টা বেশি গুরুত্ব দেন?

আবু জায়েদ: আমি লাইন-লেংথ ও সুইংয়ে জোর দিই বেশি।

খালেদ: জোরে বোলিং আর লম্বা সময় ধরে বোলিংয়েই আমার বেশি মনোযোগ...।

আবু জায়েদ: (খালেদের কথা কেড়ে নিয়ে) সিলেটে আমরা ওকে বলি ‘বুলেট খালেদ’! ভালো গতিতে বোলিং করতে পারে। এ কারণে বুলেট বলে সবাই। নিয়মিত ঘণ্টায় ১৩৬-১৩৮ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতে পারে। নিজেকে পরিচর্যা করলে হয়তো আরও বেশি গতিতে করতে পারবে। আর সে বল ভালো উচ্চতায় তুলতে পারে। আগেও বলেছি, যেকোনো দলে একজন ভয়ংকর (থ্রেট) বোলার দরকার। বিশ্বের বেশির ভাগ দলেই এটা আছে। ভারতের মোহাম্মদ শামি-ইশান্ত শর্মা জোরে বোলিং করে। ওদের সমর্থন দেয় সুইং বোলার ভুবনেশ্বর কুমার। প্রায় প্রতিটি টেস্ট দলে এমন বোলার আছে, যে আতঙ্ক ছড়িয়ে উইকেট বের করবে। স্টুয়ার্ট ব্রডকে সমর্থন দেয় জেমস অ্যান্ডারসন। আমাদের সিলেট দলে শামি-ইশান্তের ভূমিকায় থাকে খালেদ, আর আমি থাকি ভুবনেশ্বরের ভূমিকায়।

* স্টিভ রোডস বলছিলেন, তিনি একজন লম্বা বোলার খুঁজছেন। তাঁর সেই প্রত্যাশা পূরণে খালেদ আপনি কতটা আশাবাদী?

খালেদ: ভালো উচ্চতা আছে আবার দ্রুত গতিতে বোলিং করতে পারি, এ দুটি বিষয় বিবেচনা করে আমাকে নেওয়া হয়েছে। চেষ্টা করব তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে।

* ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ খারাপ করলেও জায়েদ আপনার বোলিং ভালো হয়েছে। ঘরের মাঠে এই ছন্দ ধরে রাখতে কতটা আশাবাদী?

আবু জায়েদ: যেকোনো ক্রিকেটে ভালো সূচনা হলে পরের কাজটা একটু সহজ হয়। না হলে আগে ভালো করতে হয়, পরে সেটি ধরে রাখতে হয়। যেহেতু শুরুতেই ভালো হয়েছে, চেষ্টা করব এটা ধরে রাখতে।

* উপমহাদেশের বাইরের দল বাংলাদেশে এলেই সাধারণত স্পিন-সহায়ক উইকেট তৈরি করা হয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও হয়তো ব্যতিক্রম হবে না। পেসার হিসেবে এখানে ভালো করাটা কতটা কঠিন?

আবু জায়েদ: চ্যালেঞ্জিং তো অবশ্যই। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশির ভাগ সময়ই আমরা এমন উইকেটে খেলে থাকি। লাইন-লেংথ ধরে রাখতে পারলে কঠিন কিছু হবে না।

খালেদ: বাংলাদেশে এমন উইকেটই থাকে। যদি লাইন-লেংথ আর ঠিক জায়গায় বল করতে পারি ভালো কিছুই হবে।

* সিলেটে প্রথম টেস্ট হতে যাচ্ছে। জায়েদ প্রথমবারের মতো দেশের মাঠে টেস্ট খেলতে যাচ্ছেন। আর খালেদ অভিষেকের অপেক্ষায়। সিলেট থেকে উঠে আসা ক্রিকেটার হিসেবে আপনাদের কাছে এটা কতটা রোমাঞ্চকর, আবার কতটা চাপের?

আবু জায়েদ: আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আমার অভিষেক হয়েছে এ মাঠেই। আমার কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে, খালেদের যেটা নেই। আত্মীয়স্বজনের চাপ আছে। যেটা সিলেটের বাইরে খেললে হয় না। আমরা পেশাদার ক্রিকেটার, এই চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। শুধু আমাদের জন্য নয়, পুরো দলের জন্য আশা করি সবাই দোয়া করবে। বাংলাদেশ আগে, পরে সিলেট। যেন দুটি টেস্টই জিততে পারি, সিরিজ জিততে পারি। দল জিতলে বেশি ভালো লাগবে।

খালেদ: টেস্টে এই মাঠের অভিষেক হতে যাচ্ছে। যদি আমারও অভিষেক হয়, চাইব ভালো কিছু করতে। দর্শকেরা হয়তো নানাভাবে অনুপ্রাণিত করবে। চাইব ভালো কিছু করতে। আমি এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। এটাকে চাপ মনে করি না। এ মাঠে খেলে অভ্যস্ত। চাপ থাকতে পারে। তবে এসব মাথায় নেব না। মাঠেই মনোযোগ থাকবে।

* এই সিরিজে দুজনের লক্ষ্য থাকবে কী?

আবু জায়েদ: অবশ্যই ভালো বোলিং করে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করব।

খালেদ: একাদশে সুযোগ পেলে ভালো বোলিং আর সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হওয়ার চেষ্টা করব।