বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাটট্রিক ও একটি ফিলিং স্টেশন

>
বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাটট্রিক করেছেন চেতন শর্মা। ফাইল ছবি
বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাটট্রিক করেছেন চেতন শর্মা। ফাইল ছবি

১৯৮৭ সালের এই দিনেই প্রথম হ্যাটট্রিক দেখেছিল বিশ্বকাপ

ক্রীড়া সাংবাদিকদের এই পথে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফিরোজ শাহ স্টেডিয়াম অথবা ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়াম আর বাদবাকি সব স্টেডিয়ামই জটলা পাকিয়ে আছে একে অপরের সঙ্গে। তাই এক ঘণ্টা দূরের পথ গুরগাঁও-ফরিদাবাদ সড়কে ওঠার দরকার পড়ে না। তবে কেউ আগ্রহ করে একবার সে পথে গেলেই চোখে পড়বে ফিলিং স্টেশনটি। সড়কের পাশে পড়ে থাকা অন্য আর পাঁচ-দশটি স্টেশনের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই। শুধু নামটি ছাড়া, জ্বালানি নিতে আসা যানবাহনগুলোকে জ্বলজ্বল করে ডাকছে ‘হ্যাটট্রিক ফিলিং স্টেশন’।

২০০৫ সালে নির্মিত এই ফিলিং স্টেশনের নামটি খেলার জগতে খুবই পরিচিত নাম। ফুটবলে কদিন পরপরই হ্যাটট্রিক করছেন মেসি-রোনালদো। হকিতে তো প্রায় প্রতিদিনই হ্যাটট্রিক হচ্ছে কোথাও না কোথাও। সে তুলনায় ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করা তো একটু কঠিন। পর পর তিন বলে তিনজন ব্যাটসম্যানকে ফেরানো চাট্টিখানি কথা নয়। ঠিক জায়গায় বল করতে হবে, ব্যাটসম্যানকে ফাঁকি দিতে হবে, বল আকাশে উড়লে ফিল্ডারের হাতের ওপর ভরসা রাখতে হবে। স্টাম্পে বল লাগলেও যে হ্যাটট্রিক হবে, সে নিশ্চয়তাও তো নেই। অভিষেকেই ক্রিস ট্রেমলেট হ্যাটট্রিক তো পেয়েই গিয়েছিলেন কিন্তু আশরাফুলকে ফাঁকি দেওয়া বল স্টাম্পে লেগেও যে বেল ফেলতে পারল না। ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক তাই বেশ কঠিন একটা ব্যাপার। ৪৮ বছরের ওয়ানডে ক্রিকেট তাই হ্যাটট্রিক দেখেছে মাত্র ৪৫টি।

এত সব হ্যাটট্রিকের মধ্যে দুটি হ্যাটট্রিক অনন্য হয়ে থাকবে। ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জালাল-উদ-দিনের হ্যাটট্রিক, কারণ ওয়ানডে ক্রিকেট সেদিন হ্যাটট্রিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আর ১৯৮৭ সালে চেতন শর্মার হ্যাটট্রিক। প্রথম হ্যাটট্রিক করা পাকিস্তানের জালালের প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই পেসার হ্যাটট্রিক করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশীদের বিপক্ষে। পাঁচ বছর পরে করা তাঁর হ্যাটট্রিকটি গুরুত্ব পাচ্ছে কেন? কারণ, চেতন শর্মার হ্যাটট্রিকটি ছিল বিশ্বকাপে। আজ থেকে ৩১ বছর আগের এই দিনে বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন ভারতীয় পেসার। ‘হ্যাটট্রিক ফিলিং স্টেশন’টা তাঁরই।

বিশ্বকাপে মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও নিউজিল্যান্ড। নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলছে আগেরবারের চ্যাম্পিয়নরা। ম্যাচটি শুধু জিতলে চলবে না, ভালো ব্যবধানে জিততে হবে। না হলে সেমিফাইনাল খেলতে হবে পাকিস্তানের বিপক্ষে, সেটাও আবার পাকিস্তানে গিয়ে। এই হ্যাপা কাটাতে চাইলে নিউজিল্যান্ডকে কম রানে আটকাতে হতো ভারতকে। কিন্তু ৫ উইকেতে ১৮২ রান তুলে আড়াই শর দিকে ছুটছিল নিউজিল্যান্ড। ক্রিকেটের সে দিনগুলোতে রানটা তাড়া করা বেশ কষ্টসাধ্য। ৪২তম ওভারে ডেকে আনা হলো চেতনকে। এর পরের ঘটনাটা চেতনের মুখেই জানুন, ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে দ্রুত কিছু উইকেট দরকার ছিল। ওই ওভারের প্রথম তিন বলে কোনো রান দিইনি আমি। চতুর্থ বলটাকে সুইং করালাম, সেটা রাদারফোর্ডের মিডল স্টাম্প উপড়ে নিল। পরের বলটা একটু বেশি গতিতে ছাড়লাম, এবার ইয়ান স্মিথের অফ স্ট্যাম্প ভাঙল।

নাগপুরের বিদর্ভ স্টেডিয়াম তখন নাচছে। স্ট্রাইকে তখন টেল এন্ডার চ্যাটফিল্ড। এমন সময় দলের দুই নেতা কপিল দেব ও সুনীল গাভাস্কার এগিয়ে এলেন, কপিল বলল শুধু সোজা বল করতে। আমাকে বলল, যদি হ্যাটট্রিক পাও তো ভালো আর না পেলেও সমস্যা নেই। কারণ তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট এনে দিয়েছ, আমাদের খুব দরকার ছিল এ দুই উইকেট। আমি তাই কোনো চাপ অনুভব করেনি যে হ্যাটট্রিক করতেই হবে। সানি ভাই বললেন বল স্টাম্প সোজা রাখতে আর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, হ্যাটট্রিক পাওয়ার অসাধারণ এক সুযোগ পেয়েছি।

ওভারের শেষ বলটা চ্যাটফিল্ডের স্টাম্প উপড়ে নিতেই হয়ে গেল রেকর্ড। বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক পেয়ে গেলেন বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে যাওয়া চেতন। কেমন ছিল সে মুহূর্তটি? আমি তখন আকাশে উড়ছিলাম। এই আকাশে ওড়ার অনুভূতি এরপর আরও সাতজন বোলার পেয়েছেন, লাসিথ মালিঙ্গা তো দুবার। কিন্তু চেতনের অর্জন তো ছুঁতে পারেননি এঁরা কেউ—বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিকম্যান একজনই।