যে পাঁচ কারণে হারল বাংলাদেশ

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৭ বছর পর দেশের মাঠে হারের হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়ছে বাংলাদেশ। ছবি: প্রথম আলো
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৭ বছর পর দেশের মাঠে হারের হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়ছে বাংলাদেশ। ছবি: প্রথম আলো
>বাংলাদেশের বাকি সাত টেস্ট ভেন্যুর অভিষেকে বাংলাদেশ হেরেছে। সিলেটেও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৫১ রানের হার বিরাট ধাক্কাই হয়ে এল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। জিম্বাবুয়ের কাছে এই হারের পাঁচ কারণ খুঁজে পেতে পারেন এখানে

সিলেট স্টেডিয়ামে এত দর্শক এসেছে আজ, অবাকই হতে হয়। জিততে হলে সিলেটের টিলা নয়, বাংলাদেশকে টপকাতে হবে বিশাল পর্বত। তবুও বিপুল দর্শক এসেছেন বাংলাদেশকে অনুপ্রাণিত করতে। দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ১৭ বছর পর দেশের মাঠে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে তারা। এই পরাজয় ভীষণ পোড়াচ্ছে মাহমুদউল্লাহকে, ‘অধিনায়ক ও খেলোয়াড় হিসেবে এ হার মানা কষ্টের। ভালো খেলতে পারিনি, আমরা দুঃখিত।’ তবে এই টেস্টে কেন বাংলাদেশের এই শোচনীয় হার? কারণ অনুসন্ধান তো করা যেতেই পারে...

জঘন্য ব্যাটিং
আরও একবার বাজে ব্যাটিংয়ের মূল্য দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। একটা দলের ব্যাটিং লাইনআপ কতটা নড়বড়ে হলে তারা টানা ৮ ইনিংসে ২০০ রানও করতে পারে না! গত ফেব্রুয়ারি থেকে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ যে ৪ টেস্ট খেলেছে, কোনোটিতেই স্কোর ২০০ পার করতে পারেনি। সর্বোচ্চ ১৬৯ এসেছে সিলেট টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে। সেঞ্চুরি দূরে থাক, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা করতেই পেরেছেন মাত্র দুটি ফিফটি। সর্বোচ্চ ৬৪ রান নুরুল হাসানের। টপঅর্ডারে রান নেই, মিডল অর্ডার নিষ্প্রভ। লেজের ব্যাটসম্যানদের কথা না হয় ছেড়েই দিন। সিলেট টেস্টে কী জঘন্য ব্যাটিং করল বাংলাদেশ! কাল কোচ স্টিভ রোডস বলছিলেন, তাঁরা ৯ সেশনের পাঁচটিই জিতেছেন, একটি ড্র। পাঁচটিই জিতেছেন বোলারদের সৌজন্যে। ব্যাটসম্যানদের কোনো কৃতিত্বই নেই সেখানে। বরং যে তিনটি সেশন বাংলাদেশ হেরেছে, সেটি ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়। আজও বাংলাদেশ যে এক সেশন বাকি থাকতে গুটিয়ে গেল, সেটিও ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়ই। এই ব্যাটিং দিয়ে আর যা–ই হোক, টেস্ট ক্রিকেটে যে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়, মেনে নিচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, ‘এমন ব্যাটিংয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া আসলে খুবই কঠিন। একটা জিনিস বলতে পারি, টেস্ট ক্রিকেট খেলতে যে ধরনের শৃঙ্খলা (ব্যাটিংয়ে) থাকা উচিত, আমার মনে হয় আমরা সেই শৃঙ্খলা দেখাতে পেরেছি না।’ খানিক পরে কোনো রাখঢাক না রেখে মাহমুদউল্লাহ সরাসরি বলে দিলেন কোথায় ভুলটা তাঁরা করেছেন, ‘আমরা বেশি স্ট্রোক খেলে ফেলছি। এটা আমরা হয়তো আবেগতাড়িত হয়ে করছি। এটা আমাদের কমাতে হবে। আরও বুঝে খেলতে হবে। কোন বোলারকে কখন কীভাবে খেলতে পারি, এটা দেখতে হবে। ছোট ছোট জুটিও গড়তে পারছি না। ওপর থেকে নিচে সবাই ব্যর্থ হয়েছি। এটা ঠিক করতে পারলে ঢাকা টেস্টে ভিন্ন বাংলাদেশকে দেখতে পাবেন।’

একাদশ ঠিক ছিল?
বাংলাদেশ সিলেট টেস্ট খেলতে নেমেছে এক পেসার ও তিন স্পিনার নিয়ে। কোচ কাল বলছিলেন, তাঁরা ব্যাটিংয়ের গভীরতা বাড়াতে সাত ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলছেন। সাত ব্যাটসম্যান ও চার বোলার নিয়ে খেলার ফল এই? হারের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ কি সঠিক একাদশ নিয়ে নেমেছিল? মাহমুদউল্লাহ অবশ্য মনে করেন একাদশ নির্বাচনে তাঁরা কোনো ভুল করেননি, ‘সেরা একাদশ নিয়ে যদি বলি, সঠিকই ছিল। পিচ অনেক শুষ্ক ছিল। এ কারণে এই মাঠে তিনটা স্পিনার খেলানো আমার কাছে এবং টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে মনে হয়েছে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত।’

সাকিব-তামিমের শূন্যতা পূরণ না হওয়া
সাকিব আল হাসান নেই, তামিম ইকবাল নেই—নতুন কোনো খবর নয়। তাঁদের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশ সিলেট টেস্টের প্রতিটি ক্ষণে অনুভব করেছে। প্রশ্ন হতে পারে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে কি তাঁদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়নি? না, সেটি হতে দেননি ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার কিংবা লিটন দাস। টেস্টে সেটির পুনরাবৃত্তি হয়নি। মাহমুদউল্লাহ অবশ্য বলছেন, সাকিব-তামিম না থাকার পরও জিম্বাবুয়েকে হারানোর সামর্থ্য ছিল তাঁদের, ‘সাকিব-তামিম দুজন সেরা পারফরমার। কে না চাইবে তাঁদের দলে পেতে। কিন্তু চোট তো কারও হাতে নেই। এরপরও আমাদের জিম্বাবুয়েকে হারানোর সামর্থ্য ছিল। জিম্বাবুয়েকেও কৃতিত্ব দিতে হবে, তারা ভালো ক্রিকেট খেলেছে।’

মাহমুদউল্লাহর অধিনায়কত্ব
মাহমুদউল্লাহ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব পেলেন গত জানুয়ারিতে, সাকিব চোটে পড়ায়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট দিয়ে শুরুটা ভালো হলেও পরে আর সেটি ধরে রাখতে পারেননি। ঢাকা টেস্টে বাজেভাবে হেরেছেন। মাহমুদউল্লাহ অধিনায়ক হিসেবে সাফল্য পাননি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও। মাহমুদউল্লাহর অধিনায়কত্বের ক্যারিশমাটিক কিছু দেখা গেল না এ সিলেট টেস্টেও। বেশির ভাগ সময় টিম ম্যানেজমেন্টের বেঁধে দেওয়া ছক কিংবা পরিকল্পনা ভাবনায় রেখে এগিয়েছেন। নিজ থেকেই কিছু করা কিংবা কৌশলগত দিক দিয়ে 'আউট অব দ্য বক্স' চিন্তা করতে তাঁকে কমই দেখা গেছে। যেহেতু দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ, সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হতে পারেন নিজের ব্যাটিং দিয়ে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে তিনি ব্যর্থ। এই টেস্টে করতে পেরেছেন ১৬ রান। এ বছরে ৮ ইনিংসে তাঁর সংগ্রহ ৫৮ রান। মাহমুদউল্লাহ অবশ্য বললেন, অধিনায়কত্বের চাপ তাঁর ব্যাটিংয়ে পড়েনি। খুব ভালো কথা। তিনি সব সময়ই বলেন, অধিনায়কত্বের চ্যালেঞ্জটা তিনি উপভোগ করেন। এই বাড়তি দায়িত্ব তাঁকে ভালো খেলতে উৎসাহিত করে। সামনে থেকে নেতৃত্ব না দিতে পারলে এই দায়িত্ব যে খুব একটা উপভোগ করা যাবে না, মাহমুদউল্লাহর নিশ্চয়ই অজানা নয়!

টেস্টে ওয়ানডের মেজাজ
জিম্বাবুয়ের কোচ লালচাঁদ রাজপুত পুরোনো কথাটা আজ আবারও মনে করিয়ে দিলেন, টেস্ট হচ্ছে ধৈর্যের খেলা। আপনাকে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেশন ধরে ধরে এগোতে হবে। টেস্ট স্কিলের সঙ্গে মনেরও বড় পরীক্ষা। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সেটি বুঝলেন কোথায়! খেলছেন টেস্ট, শট নির্বাচন পুরোই ওয়ানডে স্টাইলে। বিশ্বকাপের ভাবনা কি টেস্টেও চলে এল বাংলাদেশের? মাহমুদউল্লাহ অবশ্য শট খেলায় দোষের কিছু দেখেন না, ‘শট না খেললে রান করতে পারবেন না। রান না করলে কীভাবে ম্যাচ জিতবেন? আমাদের লক্ষ্য ছিল ম্যাচ জেতার। আমাদের দলের মধ্যে এ বিশ্বাস ছিল। আমি বিশ্বাস করি, টেস্ট ক্রিকেট এমন একটা খেলা যেখানে ইতিহাস তৈরি করা যায়। তার মানে এই না যে আমরা দমে যাব। আমরা অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াব। আর শট যদি ঠিকমতো না খেলতে পারেন, সেটি নিজের স্কিলের ব্যাপার।’