অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তরটাও দিলেন নাঈম

অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন নাঈম। ছবি: প্রথম আলো
অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন নাঈম। ছবি: প্রথম আলো
সামনাসামনি দেখায় সবার আগে নজর কাড়ে অদ্ভুত সারল্যে ভরা দুটি চোখ। চট্টগ্রামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই তরুণ অফ স্পিনের মোচড়ে টেস্ট অভিষেকেই জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসে। গড়েছেন টেস্ট অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সে ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। এই রেকর্ড নিয়ে বিতর্ক, বেড়ে ওঠা, আগামীর স্বপ্ন এবং আরও নানা কিছু নিয়ে কথা বলেছেন নাঈম হাসান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইকরামুল হক


প্রশ্ন: শুরুটা করি একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন দিয়ে। আপনার বয়স নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে...

নাঈম হাসান: হ্যাঁ, আমিও শুনেছি। ফেসবুকে অনেকে আমার বয়স নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলেছেন। কষ্টও পেয়েছি একটু। যা হোক, সবার প্রশ্নের উত্তরে আমি এটা বলতে চাই, আমাকে পাঁচ বছরের আগে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল, নার্সারি-কেজি এসব না পড়িয়ে সরাসরি প্রথম শ্রেণিতে। আমি যখন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলি, তখন আমার বয়স ১৭। তখনই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। এখন আমার আঠারো বছর হতে কয়েক দিন বাকি।

প্রশ্ন: যা–ই হোক, অভিষেকে বিশ্ব রেকর্ডই গড়ে ফেললেন, নিজের কাছে প্রত্যাশাও বাড়িয়ে দিলেন এতে, তাই না?
নাঈম হাসান: সেটা তো অবশ্যই। মজার ব্যাপার কি জানেন, আমি জানতামই না বিশ্ব রেকর্ড হয়ে গেছে! দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে জেনেছি। খুবই ভালো লেগেছে। আমি চেয়েছিলাম আমাকে যখন সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেটার সম্মান রাখতে। প্রথম ইনিংসে বোলিং শুরু করার সময় এটাই বারবার মনে হচ্ছিল, আমি যেন এমন কিছু করতে পারি, যাতে মানুষ আমাকে মনে রাখে। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের বোলিং নিয়ে আমি মোটেই সন্তুষ্ট না।

প্রশ্ন: প্রথমবার বাংলাদেশ দলে, প্রথমবার টেস্টে...বোলিং করার আগে এত চিন্তা, নার্ভাস লাগছিল না একটু?
নাঈম: নাহ! নার্ভাস লাগবে কেন? আমাকে তো ভালো বোলিং করে উইকেট নেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে। আমি শুধু আমার কাজটাই করতে চেয়েছি। আর সাকিব ভাই, তাইজুল ভাই, মিরাজ ভাইরা যখন বল করছিলেন, আমি দেখছিলাম তাঁরা কীভাবে বল করছেন। আমিও ও রকম ভালো জায়গায় বল করতে চাচ্ছিলাম।

প্রশ্ন: আপনার মতো উচ্চতা থাকলে তো সবাই পেসার হতে চায়। আপনি স্পিনার হয়ে গেলেন কীভাবে?
নাঈম: আমিও তো প্রথমে পেস বোলিংই করতাম। ১১-১২ বছর বয়সে চট্টগ্রামে একাডেমিতে যাওয়ার সময়ও পেস বোলিং আর ব্যাটিং করতাম। কিন্তু আমার কোচ মমিনুল হক, উনি নিজেও খুব ভালো স্পিনার ছিলেন, আমাকে বললেন স্পিন বোলিং শুরু করতে। সেই থেকে শুরু। ধীরে ধীরে দেখলাম অফ স্পিনটা ভালোই রপ্ত করতে পারছি। তারপর তো বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বিভাগীয় ক্রিকেট খেলতে শুরু করলাম। আমার বাবাও খুব উৎসাহ দিতেন।

প্রশ্ন: তার মানে আপনার পরিবারেরও চাওয়া ছিল, আপনি ক্রিকেটার হবেন?
নাঈম: তা ছিল। আমার বাবা সব সময় আমাকে সাহস দিয়েছেন। আমার যখন ৪-৫ বছর বয়স, তামিম ভাই (তামিম ইকবাল) তখন লিগ খেলেন। আমি তো ক্রিকেটের কিছুই বুঝি না। বাবা আমাকে নিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতেন। পরে আমি আরেকটু বড় হলাম যখন, আমাকে বাসার পাশে একটি একাডেমিতে ভর্তিও করে দিলেন। জীবনে শুধু একবারই বলেছিলেন, খেলাটা একটু কমাতে; আমার এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে। আমি কিন্তু তখনো পুরোদমে ক্রিকেট খেলে যাচ্ছিলাম। বিকেলে মাঠে খেলতে যেতাম, প্রতিদিন ভোরবেলা আমাদের বাসার পাশের মাঠে বোলিং প্র্যাকটিস করতাম। বাবা কখনো কখনো দেখতেনও, কিন্তু দেখে না দেখার ভান করে চলে যেতেন।

প্রশ্ন: অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলার মাঝপথে টেস্ট স্কোয়াডে ডেকে আনা হয়েছিল আপনাকে...
নাঈম: হ্যাঁ, এই বছরের শুরুতেই তো। বিশ্বকাপে আমি দুটি ম্যাচ খেলেছিলাম। তখনই আমাকে ডাকা হলো জাতীয় দলে। আমি কী যে খুশি হয়েছিলাম! অনূর্ধ্ব-১৯ খেলতে খেলতে জাতীয় দলে ডাক কজন পায়!

বন্ধুদের সঙ্গে কেক কেটে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন আনন্দ। ছবি: প্রথম আলো
বন্ধুদের সঙ্গে কেক কেটে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন আনন্দ। ছবি: প্রথম আলো



প্রশ্ন: কিন্তু অভিষেক তো হলো না সেবার...
নাঈম: তাতে কী? আমার একটুও মন খারাপ হয়নি। আমি প্রথমবার জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে আসতে পেরেছি—এই আনন্দেই তো আমি বিশ্বকাপ ছেড়ে আসার সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া সেবার আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম। বড় খেলোয়াড়েরা কীভাবে খেলে, অনুশীলন করে, কথা বলে এসব। আর যখন আমাকে খেলানো হলো না, তখন আরেকটা জিনিস মনে হয়েছে, আমি হয়তো এখনো জাতীয় দলে খেলার জন্য প্রস্তুত নই। আমার নিজের আরও উন্নতি করতে হবে। তারপর থেকে আমি আরও বেশি করে কাজ করেছি। নিজেকে এমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করেছি যাতে আমাকে আবার ডাকলে খেলানো হয়।

প্রশ্ন: প্রত্যেক ক্রিকেটারই তো একজনকে আদর্শ মেনে বড় হয়, আপনার সেই আদর্শ কে?
নাঈম: যদি বোলিংয়ের কথা বলেন, আমি নাথান লায়নের মতো বোলিং করতে চাই। তবে তিনি শুধু বোলিং করেন। আমি চাই, ব্যাটিংয়েও ভালো করতে। সেই জায়গা থেকে আমি সাকিব ভাইয়ের মতো হতে চাই। বোলিংয়েও যেমন, ব্যাটিংয়েও তেমন।

প্রশ্ন: ক্যারিয়ারের শুরু হলো, সামনের দিনে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
নাঈম: আমি তো মাত্রই শুরু করলাম, ভবিষ্যতের কথা তো বলা কঠিন। তবে আমার চাওয়া হলো, বাংলাদেশ দলকে অনেক লম্বা সময় ধরে সার্ভিস দিয়ে যাওয়া। আমার মতো অনেক নাঈমই তো আছে আমাদের দেশে, যারা সুযোগের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি জাতীয় দলে খেলার সুযোগ যখন পেয়েছি, এবার দেশকে আমার দেওয়ার পালা। আমি মাঠে খেলে বাংলাদেশকে কিছু গৌরবের মুহূর্ত এনে দিতে পারলে সেটাই আমার জীবনের বড় পাওয়া হবে। আর ব্যক্তিগত অর্জন যা আসার, তা এর সঙ্গেই চলে আসবে। ওসব নিয়ে ভাবার দরকার নেই।