সবাই জানে, সবাই বোঝে, কিন্তু...

তৃণমূল ক্রিকেটের প্রহসন কে ঠেকাবে?
তৃণমূল ক্রিকেটের প্রহসন কে ঠেকাবে?
>দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে চলছে প্রহসন। পাতানো খেলা থেকে শুরু করে কী হয় না সেখানে। আম্পায়াররা বিক্রি হয়ে যান অবলীলায়। সংগঠকেরা নিজেদের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অন্ধ। ক্রিকেটার উঠে আসার স্তরে এসব ন্যক্কারজনক কাণ্ড ঠেকাবে কে? ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব জালাল আহমেদ চৌধুরীর লেখায় উঠে এল সে আকুতিটাই

বিশাল ক্যানভাসে ঢাকা ক্রিকেট লিগের অপসংস্কৃতি আক্রান্ত হওয়ার ছবি দেখলাম দুদিন ধরে প্রথম আলোয়। দেখে মনে হলো, বিগত কয়েক মৌসুম ধরে যা দেখেছি এবং যা শুনেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ ছবি অসম্পূর্ণ। এই অপসংস্কৃতি চাষের লাঙল এত ধারালো যে খেলাটির সুচেতনার জমি একেবারে ওলট-পালট করে ফেলেছে। সেই একদা সুরম্য জমির আর্তনাদ অস্পষ্ট ফুটেছে প্রথম আলোর পাতায়। এভাবে চললে ভয়াবহ পরিণতি দৃশ্যমান হতে খুব বেশি সময় নেবে না।

এমনিতেই চিত্রটা অতি করুণ। লিগ চলছে, তরুণ ক্রিকেটারদের বিচারিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা শুনলে রবীন্দ্রনাথের পঙ্ক্তি চোখের সামনে জীবন্ত চলাচল শুরু করে, ‘আমি যে দেখেছি তরুণ বালক, উন্মাদ হয়ে ছোটে/কি যন্ত্রণায় মরিছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।’ কী করবে বালক তার স্বপ্নময় পরিশ্রম যদি এভাবে মার খায়। ম্যাচের পর ম্যাচ সে আউট না হয়েও আউট! কী করবে সে? তাঁর সঙ্গে ফতুল্লা আউটারে স্নিক হলে সে আওয়াজ সাইনবোর্ডের মোড় থেকে শোনা গেলেও, বাইশ গজের এপার থেকে আম্পায়ার শুনতে পান না। কী করবে সে, যখন সে জানে প্রতিপক্ষ দলটি অতি যত্নের সঙ্গে আবেদন অনুশীলন করে মাঠে আসে। আর তাঁকে অনুশীলন করতে হয় পায়ে যাতে বল না লাগে, সেই ব্যাটিং। এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে শুধু তারই বুক ভাঙে না, ভাঙে সেসব প্রশিক্ষকের স্বপ্নও, যাঁরা দূর মফস্বল থেকে এদের তৈরি করে ঢাকায় পাঠান। বড় ক্রিকেটার হওয়ার, ভালো ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে। আর কর্তৃপক্ষের প্রতি, ক্রিকেট সমাজের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটা পোক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। তাই বলছিলাম, ক্যানভাসের ছবিটা প্রতিবাদী সংবাদে পুরোটা আসে না। আর ক্রমে ক্রমে বিলুপ্তির পথে হাঁটে ক্ষমতাহীন, হৃদয়ের টানে মাঠে আসা সংগঠকের দল। খেলায় আগ্রহী নিরপেক্ষ দর্শক। ফিকশ্চার দেখে, মাঠে উপস্থিত বিচারকের চেহারা দেখে যখন সকালবেলাতেই ফলাফল বলে দেওয়া যায়, তখন কার আগ্রহ থাকে খেলা দেখার!

প্রাসঙ্গিক আরও করুণ গাথা আছে। সর্বজনবিদিত। বলে লাভ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন ম্যাচ রেফারিও দেখলাম বলেছেন, এসব বলে কয়ে লাভ নেই। কে যেন শোনে না ধর্মের কাহিনি।
এসব সবাই জানেন, বোঝেন, তবু কিছু হয় না। হয় না, কারণ শীর্ষ কর্তারা বলেন, তাঁরা নিচের তলার খবর রাখেন না। কিন্তু খবর রাখেন কত দল তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায়, কত দল তাঁদের বিরোধী। বলেন, বৃহত্তর স্বার্থ কেউ দেখে না। এই বৃহত্তর স্বার্থটা যে কী! সেটা আমাদের বুঝতে হবে। আমরা দেখেছি, কয়েক বছর ধরে তৃতীয় বিভাগে বাছাই ক্রিকেট হয় না। একসময় শত দল অংশগ্রহণ করত। একেবারে হয় না বলা ঠিক না। হয়। তবে অংশগ্রহণ করে মাত্র দুটি দল। আর তারাই, বাছাই হয়ে তৃতীয় বিভাগে খেলে। দুই দল আসে, কারণ বৃহত্তর স্বার্থ। এই দুই দলই পরের বছরগুলোতে তরতরিয়ে ওপরে উঠে যায়, বৃহত্তর স্বার্থের পরিকল্পিত পন্থায়। এদের জায়গা দিতে অবনমিত হয় বৃহত্তর স্বার্থের বিরোধী মনোভাবসম্পন্ন দল। এসব প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য বশংবদ, মাসিক বেতনের আওতায় আনা আম্পায়ার আছেন, আছে কৌশলী ব্যবস্থাপনা। এসব আম্পায়ার গোত্রের ভাবমূর্তির থোড়াই তোয়াক্কা করেন। তাঁদের সেবাদান চাকরির উন্নতিতে নিবেদিত। ক্রিকেট সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাবে তাঁদের কিছুই যায় আসে না। বৃহত্তর স্বার্থেই তাঁদের লক্ষ্য পূরণের তাড়া আছে। আর এভাবেই ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় দল বাড়ে, কমে বিরোধী দল। বৃহত্তর স্বার্থের চোখ সাংবিধানিক সুবিধায়, ক্ষমতা চিরস্থায়ী প্রকল্পের সুদূর নীলনকশায়।

অনাচারের জ্বলজ্বলে চিত্র যখন আকাশজোড়া প্রকাশ্য, তখন সর্বক্ষমতা নিয়ন্ত্রকেরা বলছেন, তাঁরা ঠিকমতো অবহিত নন। বলছেন সিসিডিএমের ব্যাপার, আম্পায়ার্স কমিটির বিষয়। সিসিডিএম বলছে, ‘আম্পায়ার্স কমিটিকে বলেছি। ওনারা সব পরস্পরের সংযোগহীন’, এ কথাও জনগণকে মেনে নিতে হবে? আর আম্পায়ার্স কমিটি কতটুকু সার্বভৌম অথবা কতটা মেরুদণ্ডী, সে কথা ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সবাই জানে। নোংরা আলোচনায় রুচি নেই বলে কথা বাড়ালাম না।

অবাক লাগে, যখন দেখি ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকেরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে এড়িয়ে চলা কথা বলেন। মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। জর্জরিত ক্রিকেটীয় পরিবেশ তাঁদের সমবেদনাটুকু তেমন করে পায় না। ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থ সম্ভবত তাঁদের নির্বিকার থাকারই নির্দেশ দেয়।

তা না হলে গত মৌসুমে লালমাটিয়া ক্লাবকেন্দ্রিক এত বড় প্রতীকী প্রতিবাদ দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে ঢেউ তুলল আলোচনার, তারপরও এবার এ সময়ে আমাদের এ অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে কেন? আমাদের কথার কতটুকু সত্য আর কতটুকু সত্যের অপলাপ, ভাবতে হচ্ছে। এসব অপ্রিয় প্রসঙ্গ লিখতেও ইচ্ছা করছে না। কারও পড়তে ইচ্ছে হোক, সেটাও চাই না।