সাদমানকে ক্রিকেটার হতেই হতো

অভিষেক টেস্টে মাঠে নামার আগে সাদমানকে তাঁর সতীর্থদের শুভকামনা। তাঁর অভিষেকটা রঙিনই হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
অভিষেক টেস্টে মাঠে নামার আগে সাদমানকে তাঁর সতীর্থদের শুভকামনা। তাঁর অভিষেকটা রঙিনই হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
>বাংলাদেশের ৯৪তম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট অভিষেক হয়েছে সাদমানের। বাংলাদেশ দলের তরুণ এই বাঁহাতি ওপেনার উঠে এসেছেন এক ক্রিকেট-ঘনিষ্ঠ পরিবার থেকে। ক্রিকেটার হওয়াটা তাঁর অনিবার্যই ছিল।

২০১৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ দলের পাইপলাইন সমৃদ্ধ করার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে রিচার্ড ম্যাকিন্স যখন চলে যাবেন, তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, উঠতি ক্রিকেটারদের কে কে আপনার নজর কেড়েছে? ম্যাকিন্স যে দু-তিনজন ক্রিকেটারের নাম বললেন, তাঁদের একজন সাদমান ইসলাম। সাদমান-প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়নটা ছিল এমন, ‘টেস্টে ওপেনার হিসেবে তামিমের সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা আছে ওর।’

ক্রিকেট মাঝেমধ্যে এমন অদ্ভুত সব দৃশ্যের অবতারণা করে, ভীষণ চমকে যেতে হয়! আজই দেখুন, সাদমানের টেস্ট অভিষেক, অথচ অন্য প্রান্তে নেই তামিম! চোট কাটিয়ে না ওঠায় এ টেস্টেও দলের বাইরে দেশসেরা ওপেনার। অথচ সাদমান যখন ব্যাটিং করছিলেন, কখনো কখনো দৃষ্টিভ্রম হয়েছে অনেকের—ব্যাটিং শৈলী, শট খেলার ধরন, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে যেন তামিমের ‘কার্বন কপি’! হেলমেটের মধ্যে কখনো কখনো সাদমানকে ‘ডুপ্লিকেট তামিম’ও মনে হয়েছে কারও কারও। পার্থক্যটা শুধু শারীরিক অবয়বে। মিলটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কৌতুকও হয়েছে, ‘সাদমান যেন গরিবের তামিম’!

টেস্ট অভিষেকে খেলতে নেমে তামিমের অভাব খুব বেশি বুঝতে দেননি সাদমান। ৭৬ রানের ইনিংস খেলে প্রথম দিনটা হাসিমুখে শেষ করার সুযোগ করে দিয়েছেন দলকে। তবে একজন তামিম হতে কতটা পথ হাঁটতে হবে, সাদমানের ভালোই জানা। বিকেলে সাদমান অবশ্য সহাস্যে জানালেন, দেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তামিমই তাঁর আদর্শ। স্পর্শ করা দূরে থাক, তামিমের কাছাকাছিও যদি সাদমান যেতে পারেন, সেটি বড় প্রাপ্তি হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের।

সাদমান কতটুকু পথ পাড়ি দিতে পারবেন, সময়ই বলে দেবে। তবে যতটুকু পথ পেরিয়ে এসেছেন, পেছনে তাকালে বলবেন, ক্রিকেটার তাঁকে হতেই হতো। বাবা শহিদুল ইসলাম এক যুগের বেশি সময় বিসিবিতে কর্মরত। বর্তমানে গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। একজন ক্রিকেটার হতে কোন পথে এগোতে হবে, সেটির দিকনির্দেশনা সাদমান বাবার কাছ থেকেই পেয়েছেন। ক্রিকেটার হতে বাবার ভূমিকা যে অনেক, আজ সংবাদ সম্মেলনে গর্বভরা কণ্ঠে বললেন তরুণ ওপেনার, ‘আব্বু সব সময় সহযোগিতা করেছেন। অনূর্ধ্ব–১৫, ১৭ দলের ক্যাম্পে সব সময়ই তিনি আমাকে নিয়ে যেতেন। ছোটবেলা থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল খেলোয়াড় হব। যেভাবে আব্বু খেলার জন্য বলেছেন, একাডেমি কিংবা স্কুল ক্রিকেট থেকে ওভাবেই তৈরি হয়েছি। আমাকে অনেক সমর্থন করেছেন খেলতে। কীভাবে খেলতে হয়, কীভাবে জীবন গড়তে হয় একজন ক্রিকেটারকে, আমাকে এখনো তিনি বলেন। চেষ্টা করি ওভাবে নিজেকে তৈরি করার।’

সাদমানের বাবা, ক্রিকেটাঙ্গনে যিনি ‘শহীদ ভাই’ নামে পরিচিত। ছেলের এই স্মরণীয় দিনটা মাঠে থেকে দেখা হয়নি। পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় বিসিবিতে আজ আসেননি, ছেলের খেলা তিনি দেখেছেন টিভিতে। সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বললেন, ক্রিকেটার হতে ছেলেকে অনুপ্রাণিত করেছেন, কখনো জোর করেননি, ‘সবাই চাইলেই ক্রিকেটার হতে পারে না। অনেক বিষয় জড়িয়ে এখানে। শুধু অনুশীলন করলেই হয় না। ও যখন উইলস লিটল ফ্লাওয়ারে পড়ত, স্কুল ক্রিকেটে ভালো করতে শুরু করল। কোচ আনোয়ার ভাই পরামর্শ দিলেন, ছেলেকে ক্রিকেটে দেওয়া যেতে পারে। ও প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ রান করেছে। বয়সটা একটু কম হওয়ায় ২০১২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি। পরে ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক (৪০৬) হয়েছে।’

এ যুব বিশ্বকাপটাই যেন সাদমানের ক্যারিয়ারের বড় বাঁক বদল। সে হিসেবে একটু দেরি হলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখতে। মধ্যে খেলেছেন ৪২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ৪৬.৫০ গড়ে ৭ সেঞ্চুরি ও ১৬ ফিফটিতে করেছেন ৩০২৩ রান। সাদমানের যে অভিষেক হতে যাচ্ছে গত কদিনে সেটি যেন ‘ওপেন সিক্রেট’। বাংলাদেশের ৯৪তম টেস্ট ক্রিকেটার সম্পর্কে কাল বড় সনদই দিয়েছেন সাকিব আল হাসান, ‘টেস্ট ক্রিকেটের জন্য সে দারুণ সম্ভাবনা। যতটুকু দেখেছি এবং শুনেছি, ওর খেলার ধরন টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে খুব মানানসই।’

সাকিব যে ‘টেস্টের সঙ্গে মানানসই’ বলেছেন, সেটিই আজ দেখা গেছে। ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে ২২০ মিনিট উইকেটে থেকে ১৯৯ বল খেলে করেছেন ৭৬ রান। অভিষেক টেস্ট, স্বাভাবিকভাবে স্নায়ুচাপ থাকবে। সেটি উতরে যেতে উইকেটে সাকিব-সৌম্য বারবার পরামর্শ দিয়েছেন, ‘তুমি যেভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাটিং করো, যে শটগুলো পারো, সেভাবেই খেলো। অতিরিক্ত কিছু করতে যেও না। সব সময় যেভাবে সহজাত শটগুলো খেলো, ঠিক সেভাবেই তোমার খেলাটা খেলো।’

সাদমান তা-ই করেছেন। বাংলাদেশের ওপেনারদের উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসার যে প্রবণতা, সেটি অন্তত অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে তাঁকে করতে দেখা যায়নি। তবে এত সুন্দর যাঁর শুরু, সেঞ্চুরিটা পাওনা ছিল। না হওয়ায় খুব একটা আফসোস অবশ্য সাদমানের নেই, ‘তেমন হতাশা নেই ....অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরির চাওয়া তো সবারই থাকে। তবে কোনো হতাশা নেই। চেষ্টা করেছি। যতটুকু দরকার ছিল সেভাবে ব্যাটিং করেছি। হয়তো পুরোটা পারিনি। যে রকম দরকার ছিল শেষ করতে পারিনি। মনে হয় আরেকটু দিতে পারতাম।’

এখানেই শেষ নয়, কেবল তো শুরু ; তাঁর দেওয়ার আছে অনেক। ক্রিকেটঘনিষ্ঠ পরিবার থেকে উঠে আসা সাদমানের বড় চ্যালেঞ্জ এটাই, যাত্রাটা যেন থেমে না যায় অসময়ে।