যুদ্ধের দুঃখ ভুলে মদরিচের উদ্যাপনের বছর

ব্যালন ডি`অর হাতে সেরা সময় কাটাচ্ছেন মদরিচ। ছবি: এএফপি
ব্যালন ডি`অর হাতে সেরা সময় কাটাচ্ছেন মদরিচ। ছবি: এএফপি

গতকাল প্যারিসে শুধু আনুষ্ঠানিকতাই বাকি ছিল। মুখে মুখে আগেই রটে গিয়েছিল, ১০ বছর পর মেসি রোনালদো বাদে অন্য কারও মাথায় শোভা পেতে যাচ্ছে বর্ষসেরার মুকুট। ২ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে কাকা যে মুকুট পরেছিলেন, তার ঠিক ১১ বছর পর সেই মুকুট পড়তে চলেছেন লুকা মদরিচ। মাঝের ১০ বছরে মেসি-রোনালদোর ‘রাজত্ব’ যে শেষ। সময়টা এখন নতুন রাজার—লুকা মদরিচ।

বছরের শুরুতেও রিয়াল মাদ্রিদের অন্য দশটা খেলোয়াড়দের সমান ছিলেন লুকা মদরিচ। ২০১৭ সালে ‘সেরা মিডফিল্ডার’ হিসেবে শিরোপা পেলেও সেভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন না মদরিচ। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে মদরিচ চিত্রটা পাল্টে দিলেন। বছরের সেরা মিডফিল্ডার থেকে বছরের সেরা খেলোয়াড়—পথটা কি এতটাই সোজা ছিল?

২০১৭-১৮ মৌসুমের শুরুতে হামেস রদ্রিগেজের বিদায়ের পর রিয়ালের ‘১০’ নম্বর জার্সি তুলে দেওয়া হয় লুকা মদরিচের কাঁধে। দশ নম্বর জার্সি একরকম বোঝা হয়ে ছিল রিয়ালের কাছে। লুই ফিগোর পর রদ্রিগেজই ‘১০’ নম্বর জার্সিতে কিছুটা মেলে ধরতে পেরেছিলেন নিজেকে। মদরিচ এই জার্সির ভার সইতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। প্রথাগত গোলদাতা নন এই ক্রোয়াট। তবে মাঝমাঠ থেকে খেলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটা ভালোই আছে। মৌসুমের পরিসংখ্যান তুলে ধরলে তিনি হয়তো সেভাবে পাত্তা পাবেন না। কিন্তু মাঠে ইঞ্চিখানেক জায়গা ছাড়লে মদরিচের প্রভাব বুঝতে সময় লাগে না।

পরিবারের সঙ্গেই সময়টা উদ্‌যাপন করছেন মদরিচ। ছবি: এএফপি
পরিবারের সঙ্গেই সময়টা উদ্‌যাপন করছেন মদরিচ। ছবি: এএফপি

কোচ জিনেদিন জিদানও তাঁকে আর রোনালদোকে ব্যবহার করেছেন দলের তুরুপের তাস হিসেবে। লা লিগায় মদরিচের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে তাঁর ওপর বেশি নির্ভর করেছিলেন জিদান। এই ট্যাকটিসে রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছে টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ।

লুকা মদরিচের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল রাশিয়া বিশ্বকাপ। পুরো বিশ্ব যেদিকে তাকিয়ে থাকে, সেই বিশ্বকাপে জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি ‘গোল্ডেন বল’। ‘গ্রুপ অব ডেথ’ খ্যাত ‘ডি’ গ্রুপে মদরিচের ক্রোয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া আর আইসল্যান্ড। সেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপ বাদে অন্য কোনো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের বৈতরণি পার হতে পারেননি ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু গ্রুপ পর্বেই আলো কেড়েছে ক্রোয়েশিয়া, মদরিচ ছিলেন যার পুরোধা। নিজের জাত চিনিয়েছেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষেও। আর্জেন্টিনার জালে তৃতীয় গোলটা এখনো চোখে লেগে আছে অনেকের।

নকআউট পর্ব আর কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকার জয়কে যদি ভাগ্যের জোর বলেন, তবে এটাও স্বীকার করতে হবে, ক্রোয়েশিয়া এই বৈতরণি পার হয়েছে মদরিচের অসাধারণ অধিনায়কত্বে। নিজেদের শক্তির জায়গাটা জানতেন মদরিচ, আর সে জন্যই খেলাকে নিয়ে গিয়েছিলেন টাইব্রেকারে। গোলকিপার সুবাসিচের অসাধারণ গোলকিপিংয়ে সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া। সেখানে অতিরিক্ত সময়ের গোলে বিশ্বকাপের ফাইনালও নিশ্চিত করেছিল ক্রোয়েশিয়া।

বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল হাতে। ছবি সংগৃহীত
বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল হাতে। ছবি সংগৃহীত

ফিফা ‘বেষ্ট’ শিরোপাও বগলদাবা করেছেন মদরিচ। গত দুই বছর ধরে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যে শিরোপাকে একান্ত নিজের করে রেখেছিলেন। সেই শিরোপায় ভাগ বসান মদরিচ। সেখান থেকেই তাঁর রাজত্ব শুরু। রোনালদোর বিদায়ের পর রিয়ালের সবচেয়ে বড় তারকা মদরিচই। কিন্তু কোচ লোপেতেগির অধীনে তার গুরুত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছিল, যার প্রভাব পরেছিল মাঠে। তবে নতুন কোচ সোলারির অধীনে নিজেকে আবারও মেলে ধরেছেন মদরিচ। ফিফা কিংবা ‘ফ্রান্স ফুটবল’ বাদ দিন অনেকের কাছেই, এই বছরের সেরা খেলোয়াড়ের নাম লুকা মদরিচ। বিপরীত যুক্তি থাকতেই পারে, তবে মদরিচকে অস্বীকার করা কঠিন।

ছোটবেলা কেটেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়ায়। গোলাগুলির শব্দে সকাল হতো সেই এলাকায়। ছোট্ট শরণার্থীশিবির থেকে যে ফুটবল খেলার শুরু, তা ডায়নামো জাগরেব, টটেনহাম হয়ে এখন রিয়াল মাদ্রিদে, আর মদরিচও দিনে দিনে হচ্ছেন আরও পরিণত। এক মৌসুমেই জিতেছেন গোল্ডেন বল, ফিফা বেস্ট আর ব্যালন ডি’অর। পেছন ফিরে তাকিয়ে যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি মনে করলে, মদরিচের জন্য সময়টা এখন দুঃখ ভুলে উদযাপনের।