রাজনীতিতে যে কাজটা 'কঠিন' মনে হচ্ছে মাশরাফির

নড়াইল জেলা পরিষদে মতবিনিময় সভায় ভাষণ দিচ্ছেন মাশরাফি। ছবি: রানা আব্বাস
নড়াইল জেলা পরিষদে মতবিনিময় সভায় ভাষণ দিচ্ছেন মাশরাফি। ছবি: রানা আব্বাস

অতঃপর মাশরাফি বিন মুর্তজাকে পাওয়া গেল তাঁর মামা নাহিদুর রহমানের বাসায়। পরনে নীল পাঞ্জাবি আর কালো চাদর। কাল প্রচারণার প্রথম দিনটা কেটেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। একটু যেন দম নেওয়ার সময় পেলেন সন্ধ্যায়, আর এ সুযোগে চলে এলেন পরিবারের কাছে।

বাবাকে কাছে পেয়ে মেয়ে হুমায়রা আর ছেলে সাহেল মুর্তজা শুরু করল তাদের ‘চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা’! খুদে চিত্রশিল্পী সাহেলকে কেউ একজন অনুপ্রাণিত করল একটা নৌকার ছবি আঁকতে। ‘নৌকা আঁকা তো অনেক সহজ’ বলেই মাশরাফি-তনয় দ্রুতই ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার অঙ্কন প্রতিভা দেখাতে। এলোমেলো কিছু রেখাচিহ্নে শেষ পর্যন্ত নৌকার ছবি আঁকা হলো কি না, ঠিক বোঝা গেল না। তবে মাশরাফি হেসে বাঁচেন না তাঁর সন্তানদের স্লোগান শুনে। ছেলেমেয়ে দুজনই সুর করে স্লোগান ধরেছে, ‘মাশরাফি ভাইয়ের সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন!...বি কেয়ারফুল বি কেয়ারফুল!’

নির্বাচনের মৌসুমে তাঁর অবুঝ ছেলেমেয়েই শুধু তাঁকে ‘মাশরাফি ভাই’ বলে ডাকছে না, কান পাতলে নড়াইল-২ আসনজুড়েই শোনা যাচ্ছে এই নাম। একাদশ সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো এলাকায় এসেছেন পরশু। প্রচারণা শুরু করেছেন কাল থেকে। বিরতিহীন চালিয়ে যাচ্ছেন গণসংযোগ আর মতবিনিময় সভা।

এ আসনে ভোটার ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৫১২। ১৯০ ওয়ার্ডে ইউনিয়ন আছে ২০টি। প্রচারণার প্রথম দিনে যেতে পেরেছেন মাত্র তিন ইউনিয়নে। যেহেতু ২৭ তারিখের পর প্রচার-প্রচারণা বন্ধ, চার দিনে বাকি ইউনিয়নগুলোয় যেতে পারবেন কি না, সংশয়ে আছেন। তবুও চেষ্টার কমতি রাখছেন না। আজ যেমন যাবেন মিঠাপুর বাজার, ঝামার ঘোপ বটতলা, লাহুড়িয়া, মাকড়াইল স্কুল মাঠ, তালতলা অফিস, ছত্রহাজারী, মানিকগঞ্জ বাজার, মরণ মোড়, চাচই স্কুল মাঠ, সিডি স্কুল, কালনা বাজার, লংকারচড় ও পাঁচাইলঘাট এলাকায়।

নির্বাচনী প্রচার শুরু সকাল ১০ থেকে, শেষ হবে কটায়, মাশরাফি নিজেও জানেন না। কাল রাত ১২টা পর্যন্তও তাঁকে ব্যস্ত দেখা গেল নেতা–কর্মীদের নিয়ে সভা-বৈঠক করতে। নিজে যেহেতু তরুণ, বেশির ভাগ তরুণ নেতা-কর্মীকে দেখা যাচ্ছে তাঁর আশপাশে। প্রবীণ নেতারা উপস্থিত থাকছেন মূলত মতবিনিময় সভায়।

এত দিন শুধু ক্রিকেট মাঠে খেলেছেন মাশরাফি। এখন খেলতে হচ্ছে রাজনীতির মাঠে। দুই মাঠের মধ্যে যদিও কোনো পার্থক্য দেখছেন না মাশরাফি, ‘কিছুই মনে হচ্ছে না। আমি বর্তমানে থাকতে চাই। গত ৪৫ দিনে আমার জীবনে যে বিষয়টির গুরুত্ব দিয়েছি, বর্তমানকে গুরুত্ব দেওয়া। বর্তমানে যেটা আসছে শুধু সেটাই সামলাচ্ছি।’

মাশরাফি এখনো পর্যন্ত ভালোভাবেই সামলাতে পারছেন সবকিছু। তবে রাজনীতির মাঠে এসে কঠিন মনে হচ্ছে শুধু বক্তৃতা দেওয়াটা। কাল রাতে নড়াইল পৌরসভায় মতবিনিময় সভায় নিজের দুর্বলতা অকপটেই স্বীকার করে নিলেন মাশরাফি, ‘রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলতে পারছি না এখনো। এখনো খেলাধুলা করি। আপনারা দেখেছেন আমাকে খেলাধুলা করতে। আপনারা সেভাবেই আমাকে চেনেন। ওভাবেই থাকতে চাই আপনাদের কাছে। নড়াইলে মুরব্বি যাঁরা আছেন, তাঁদের সামনে এমনি কথা বলতে আমার একটু অস্বস্তি লাগে। আমি আসলে অত সুন্দরভাবে বলতেও পারি না।’ বিনয় করেই বলছেন, সুন্দরভাবে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে পারেন না। তবে মাশরাফি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ‘সুন্দর নড়াইল’ গড়ার।

স্থানীয় রাজনীতিকেরা মনে করছেন, সুন্দর নড়াইল গড়তে হলে মাশরাফিকে শুধু সাংসদ হলেই চলবে না, হতে হবে মন্ত্রিসভার সদস্যও। নড়াইল জেলা পরিষদের সভাপতি সোহরাব হোসেন বিশ্বাস বেশ আত্মবিশ্বাসী, মাশরাফি ভবিষ্যতে মন্ত্রিত্বও পাবেন, ‘আমাদের এখানে দল যার যার, মাশরাফি সবার। সে অত্যন্ত যোগ্য ছেলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে ভীষণ স্নেহ করেন। অনেক পছন্দ করেন বলেই তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আর যেহেতু প্রধানমন্ত্রী নিজের আগ্রহে মনোনয়ন দিয়েছেন, আমাদের বিশ্বাস, মাশরাফি জিতলে এবং আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলে সে মন্ত্রিত্বও পাবে। এর আগে কখনো নড়াইল থেকে আমরা মন্ত্রী পাইনি। আশা করি, মাশরাফিকে দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ হবে। এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ক্ষমতার কাছে থাকাটা খুব জরুরি।’

মাশরাফি আগেই বলেছেন, ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চান না, থাকতে চান বর্তমান নিয়ে। মন্ত্রী হতে পারবেন কি, পারবেন না, সেটি নিয়েও তাঁর ভাবনা নেই।

একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, বড় মাপের ক্রীড়া তারকা। অতীতে রাজনৈতিক পরিচয় না থাকুক এলাকার মানুষের কাছে তাঁর ভাবমূর্তিটা অন্য রকম। তাঁকে নিয়ে মানুষের ভীষণ আগ্রহ। অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে তাঁর ভোটপ্রার্থনার ধরনটাও তাই ভিন্ন। মাশরাফিকে ভোট চাইতে হচ্ছে সেলফি-ছবি তুলে! তবে একজন ‘ওজনদার’ প্রার্থী হয়েও হালকাভাবে দেখছেন না প্রতিপক্ষকে, যেভাবে দেখেন না ক্রিকেট মাঠেও, ‘আমার ভেতর কখনো আত্মতৃপ্তি কাজ করে না। ক্রিকেটে কখনো কাজ করেনি। সে অভ্যাসটা রয়ে গেছে। আজকের ম্যাচে যা করেছি, সেটি মাথায় রেখে পরের ম্যাচে খেলতে নামি না। রাজনৈতিক মাঠেও তৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি প্রত্যাশা করছি, ভোটের মাঠে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হবে। প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবাটা বোকামি।’

প্রশাসন, নিজের নেতা-কর্মীদের মাশরাফি অনুরোধ করেছেন প্রতিপক্ষকে হয়রানি কিংবা হেয় প্রতিপন্ন না করতে, ‘প্রতিপক্ষকে এমন কিছু করা যাবে না, তারা আঘাত পায়। বলেছি, তারা তাদের মতো কাজ করুক, আমরা আমাদের মতো কাজ করি।’

এত অনুরোধের পরও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। এমনকি নিজের দলের লোকজনও অনেক জায়গায় গোপনে প্রতিপক্ষের হয়ে কাজ করছে বলে অভিযোগ আসছে তাঁর কানে। মাশরাফি তবুও চেষ্টা করছেন সব সামলে নিতে, সবার মন জয় করতে, যেভাবে তিনি করে থাকেন ক্রিকেট মাঠে। ক্রিকেট মাঠে সফল হলেও রাজনীতি মাঠে হতে পারবেন কি না, সেটি অবশ্য এখনই বলার সময় হয়নি।