সাক্ষাৎকারে মাশরাফি: আমি এখনো পুরো রাজনৈতিক মানুষ নই

>

মাশরাফি বিন মুর্তজা খেলার মাঠ আর রাজনীতির মাঠের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন না। রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতেই যা একটু জড়তা। নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত মাশরাফিকে পাওয়া গেল রোববার রাত ১০টায়। মুখোমুখি হলেন প্রথম আলোর। রাজনীতিতে নাম লেখানো ও নির্বাচনী প্রচারণায় নামার পর প্রথমবারের মতো কোনো পত্রিকাকে সাক্ষাৎকার দিলেন মাশরাফি। নড়াইল থেকে রানা আব্বাস

* শনিবার যখন ঢাকা থেকে নড়াইলে এলেন, হাজার হাজার মানুষের ভিড়। আগেও নড়াইলে আপনি এসেছেন। কিন্তু আপনাকে একপলক দেখতে এত ভিড় হয়নি বলেই শুনেছি। আগের নড়াইলে আসা আর এই আসার মধ্যে পার্থক্য কী মনে হয়েছে?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: পুরোপুরি নতুন অভিজ্ঞতা। এখনো খেলোয়াড় হিসেবেই এসেছি, শুধু নতুন একটা পরিচয় যোগ হয়েছে নামের পাশে। এ কারণেই হয়তো অন্য রকম মনে হচ্ছে। আর আপনার যত নতুন পরিচয় যোগ হবে, তত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হবে। এই নতুন অভিজ্ঞতা অবশ্যই ভালো লাগছে। মানুষের এত ভালোবাসা একই সঙ্গে আমার দায়িত্বটা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

* দায়িত্বের কথা বললেন, ক্রিকেট মাঠে একজন অধিনায়কের দায়িত্ব হচ্ছে পুরো একাদশের ভারটা নিজের কাঁধে নেওয়া। রাজনীতির মাঠে আপনার দায়িত্বটার ধরনটা কী?
মাশরাফি: দায়িত্বের বিষয়টা নির্বাচনের আগে বলতে পারব না। আমি বোঝাতে চাইছি আমার প্রতি সবার প্রত্যাশা অনেক।

* আপনি রাজনীতিতে এসেছেন তারকা পরিচিতি নিয়ে। ভোট চাওয়ার সময় দেখা যাচ্ছে ভোটারদের সেলফি-ছবির আবদার মেটাতেই বেশি সময় দিতে হচ্ছে। অন্য নেতানেত্রীদের হয়তো এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে না। এটা কেমন লাগছে?
মাশরাফি: আমি কিন্তু এখনো পুরো রাজনৈতিক মানুষ নই। যেদিন খেলা একেবারেই ছেড়ে দেব, সেদিন হয়তো নিজেকে পুরোপুরি রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে পারব। তার আগে পুরোপুরি রাজনীতিক হওয়ার সুযোগ নেই। আমি রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছি বলে আপনি আমাকে রাজনীতিবিদ বলছেন। আর এই যে ভোট চাওয়ার সময় এত সেলফি-ছবি তুলতে দেখছেন, এসবের সঙ্গে আমি আগ থেকে অনেকটা অভ্যস্ত। ফলে আমি খুব একটা বিরক্ত বা এসবে খারাপ লাগা কাজ করছে না।

* নানা শ্রেণির, নানা পেশার, নানা বয়সের, নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে আপনাকে দিন-রাত এক করে ঘুরতে হচ্ছে, মিশতে হচ্ছে। ক্লান্তি এসে যাচ্ছে না?
মাশরাফি: এটা আমার পুরোনো অভ্যাস। আমাকে কোনো ক্লান্তি স্পর্শ করছে না। এখন হয়তো বৃহৎ পরিসরে হচ্ছে। তবে আগে যখন এলাকায় এসেছি, তখনো এভাবে মিশেছি। তবে এবার অনেক বড় পরিসরে মিশতে হচ্ছে।

* নির্বাচনের আগে সব প্রার্থীই ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আপনি কী ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন?
মাশরাফি: নির্বাচনের আগে এগুলো সংবাদমাধ্যমে বলতে চাই না। শুধু এতটুকুই বলি, নড়াইলে সব খাতেই উন্নয়ন দরকার। একেক মানুষ একেক স্বপ্ন নিয়ে এগোয়। এখনই সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলা ঠিক নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাবে আমাকে কী করতে হবে।

* ক্রিকেট মাঠের অধিনায়কত্ব আর রাজনীতির মাঠের নেতৃত্ব, দুটির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী মনে হচ্ছে?
মাশরাফি: কিছুই মনে হচ্ছে না। আমি বর্তমানে থাকতে চাইছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দেওয়ার পর গত ৪৫ দিনে আমার জীবনে যে বিষয়টির আমি গুরুত্ব দিয়েছি, বর্তমানকে গুরুত্ব দেওয়া। নিজেকে বলছি, বর্তমানে যেটা আসছে শুধু সেটাই সামলাও। এর আগে আমি ব্যস্ত ছিলাম খেলা নিয়ে। তখন আপনারা (সংবাদমাধ্যম) বলেছেন, আমাকে ভীষণ মানসিক চাপ ঘিরে ধরেছে। একবারের জন্যও আমার সেটা মনে হয়নি। আমি বর্তমানকে গুরুত্ব দিয়েছি। যখন খেলার মধ্যে ছিলাম, একবারের জন্যও নির্বাচন নিয়ে ভাবিনি। একটা সেকেন্ডের জন্যও না। যখন খেলা শেষ, ওই সময় যদি সিরিজ না-ও জিততাম, তবুও এখানেই মনোযোগ দিতে হতো। (ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে) সিরিজ জেতায় যেটা হয়েছে, মনে আনন্দ নিয়ে কাজ করতে পারছি।

* নির্বাচনী প্রচারণার এই দুই দিনে আপনার সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটা মনে হয়েছে?
মাশরাফি: এখন পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ আসেনি। এখন পর্যন্ত চ্যালেঞ্জিং মনে হয়নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক আমাকে ৫ দিনে যেতে হবে ২০ ইউনিয়নে। এখনো পর্যন্ত যেতে পেরেছি ৩টিতে। আমি যতদূর পারছি চেষ্টা করছি। সবার কাছে তো আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। আমার যেহেতু চিকিৎসা চলছিল। চিকিৎসা শেষ না করেও আসতে পারছিলাম না এলাকায়। সামনে আবার আমার খেলা আছে। সেটাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, এটা একদিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ যে আমাকে প্রচারণা শেষ করতে হবে ৫ দিনেই। ২৭ তারিখের পর আপনি আর প্রচারণা চালাতে পারবেন না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।

* ভোটের মাঠে যাদের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে কি আপনার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে?
মাশরাফি: না, আমার সঙ্গে আসলে দেখা হয়নি তাঁদের। তবে আমি মনে করি প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবা সবচেয়ে বোকামি, সে যে-ই হোক। প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা-সম্মান সবই আছে। আমার প্রতিপক্ষ যেন মানসিক-শারীরিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন না হন, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে তাঁদের দুর্বল প্রতিপক্ষও ভাবছি না।


* নড়াইল-২ আসনে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৫১২ জন ভোটার আছেন। সবাই তো আর আওয়ামী লীগের সমর্থক হবেন না। বিরোধী মানসিকতার ভোটারদের টানতে আপনার ভাবনাটা কী?
মাশরাফি: সবাইকে একটা কথা বলেছি, আমি নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছি। তবে দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রতি বার্তা ছিল, নড়াইলের জন্য কাজ করতে চাই। এলাকার মানুষকে একটু সেবা করতে চাই। দলমত-নির্বিশেষে সবাই যদি আমাকে সহযোগিতা করেন, তবে নড়াইলে বৃহৎ পরিসরে কাজ করার সুযোগ আসবে আমাদের। এর চেয়ে বেশি তাদের বলার সুযোগ আমার নেই। তবুও বলেছি, দিন শেষে যদি মনে হয় আপনাদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা আছে, তবে আমাকে বিবেচনা করবেন। সবাই আমাকে সহযোগিতা করলে তবেই আমি ভালো কাজ করতে পারব।

* নির্বাচনী প্রচারণায় একটা খরচ-খরচা তো আছেই। শুনলাম এখনো পর্যন্ত প্রচারণা করতে গিয়ে আপনার ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়নি! কীভাবে সম্ভব হচ্ছে বিষয়টা?
মাশরাফি: সত্যি কথা, একটা টাকাও আমি নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করিনি। করবও না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব জানেন, জেলা আওয়ামী লীগেরও ব্যাপার। আমি কোনো টাকা-পয়সা খরচ করছি না এ কারণে, তাঁদের জন্য কাজ করতে এসেছি। টাকা-পয়সা সম্পর্কিত কিছু করতে আসিনি। তাঁদের জন্য কাজ করতে চাই, এ তাগিদে এখানে এসেছি।

* নড়াইল জেলা পরিষদের মতবিনিময় সভায় বলেছেন, আপনি বহর পছন্দ করছেন না। অথচ এটা নির্বাচনী প্রচারণায় খুবই পরিচিত দৃশ্য। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বহর কেন পছন্দ করছেন না?
মাশরাফি: আমি এমনই। আমি একজন খেলোয়াড়। নড়াইলে এলে খেলোয়াড় হিসেবে চলাফেরা করেছি। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে চলার সময় এলাকায় মুরব্বিদের দেখলে একটু সরে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাই। বহরটা আমি একটু কম পছন্দ করি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা তো আরও খারাপ। আমার বহর নিয়ে চলাফেরা দেখে কারও খারাপ লাগতেও পারে। বলেছি, বহর নিয়ে চলাফেরা নয়, আমি বরং সবার কাছে গিয়ে দেখা করে আসব।

* নড়াইলের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তারা শুধু আপনাকে সাংসদ হিসেবে নয়, ভবিষ্যতে মন্ত্রী হিসেবেও দেখতে চায়। আপনার লক্ষ্যটা কী?
মাশরাফি: এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। আগে তো জিততে হবে। আমি বর্তমানে থাকতে চাই। আর অত স্বপ্ন দেখি না। এই মুহূর্তে আমার স্বপ্ন একটাই, নড়াইলের যত সমস্যা আছে সে সব নিয়ে কাজ করা।

* রাজনীতিক মাশরাফির সব কাজ কি নড়াইলকেন্দ্রিকই হবে? আপনি একজন ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদান রাখার ইচ্ছে নেই?
মাশরাফি: আমার কাজ যদি সারা বাংলাদেশের মানুষের ভালো লাগে, তবে যার যার জায়গা থেকে সবাই অনুপ্রাণিত হবে ভালো কিছু করতে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের সবাই সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে। জনসেবায় সুশিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রাণিত হওয়াটা খুব জরুরি। তরুণ প্রজন্ম যা পারে, অন্যরা তা পারে না। ক্রীড়াক্ষেত্রে যেভাবে আমাকে চাইবে, আমি চেষ্টা সেভাবেই করব কাজ করতে। খেলার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক। ক্রীড়াক্ষেত্রে আমাকে যে যেভাবে চাইবে আমি তাদের সঙ্গে থাকব। ৩০ তারিখের পর যদি আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষও হয়ে যায় তবুও সেটার সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমি খেলাধুলার মানুষ, খেলার সঙ্গে সব সময়ই সম্পর্ক রাখতে চাই।

* আপনি যখন রাজনীতিতে নাম লেখালেন, আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল ভীষণ চাপের মধ্যে আছেন। ইতিবাচক-নেতিবাচক নানা কথা শুনতে হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে সেই চাপ থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছেন। কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
মাশরাফি: খুব স্বাভাবিক, ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ থাকবে। আমাদের দেশে যেহেতু রাজনীতিতে প্রচুর কাদা ছোড়াছুড়ি হয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কম সম্মান দেয় মানুষ। বিভিন্ন কারণে কম সম্মান দেয়। কিন্তু শেষমেশ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যেটা করে দেয়, সেটার সুফল ভোগ করতে হয়। কম করেন, আর বেশি করেন, তাদের করা কাজের ফলই ভোগ করতে হয়। বাংলাদেশে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ, সংখ্যাটা একটু বেশিই। দল যার যার, দেশটা তো সবার। আমি রাজনীতিতে একটা থিম নিয়ে এসেছি, প্রতিপক্ষের সঙ্গে রেষারেষি, কাটাকাটি, মারামারি করে চলতে চাই না। আমি এই এলাকার সন্তান, এলাকার জন্য কাজ করতে চাই। এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ আমার লক্ষ্য। আমার এলাকার বাইরে যারা, অন্য মতাদর্শে বিশ্বাসী যারা, তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কী আর করা, এটাই আমাদের সংস্কৃতি। রাজনীতিতে যখন এসে পড়েছি, আমার মন এখন আরও শক্ত হয়েছে। যে মানুষগুলো কষ্টে আছে, সুবিধাবঞ্চিত আছে, তাদের কাছে যাওয়ার উপায় এটাই (রাজনীতিতে আসা)। আপনি এককভাবে কতটুকু করতে পারবেন? আমি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে, আরামদায়ক পরিবেশে একে গালি দিচ্ছি, ওকে উড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ভাই, মাঠে আসেন। বাস্তবতা দেখেন। দেখেন, হাজার হাজার মানুষ সুবিধাবঞ্চিত। যে প্রশ্ন করেছিলেন, আমি নড়ে যাইনি, আরও শক্ত হয়েছি। আমার এলাকায় যারা সুবিধাবঞ্চিত, কষ্টপীড়িত, ওরাই আমার শক্তি। ওদের পাশে দাঁড়াতে এটাই আমার কাছে সেরা উপায় মনে হয়েছে।

* আপনি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, বড় তারকা। অতীতে রাজনৈতিক পরিচয় না থাকুক, মানুষের কাছে আপনার ভাবমূর্তিটা অন্য রকম। আপনাকে নিয়ে মানুষের অনেক আগ্রহ। এসব বিষয় কি আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করছে যে আসন্ন নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জিতবেন?
মাশরাফি: আমার ভেতর কখনো আত্মতৃপ্তি কাজ করে না। ক্রিকেটে কখনো কাজ করেনি। সে অভ্যাসটা রয়ে গেছে। আজকের ম্যাচে যা করেছি সেটি মাথায় রেখে পরের ম্যাচে খেলতে নামি না। রাজনৈতিক মাঠেও তৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি প্রত্যাশা করছি ভোটের মাঠে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হবে। আগেই বলেছি, প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবার সুযোগ নেই।