মুশফিকের মন খারাপের আসল কারণ

নিউজিল্যান্ডে এখনো পর্যন্ত জ্বলে উঠতে পারেননি, তাই মন খারাপ মুশফিকুর রহিমের। ছবি: প্রথম আলো
নিউজিল্যান্ডে এখনো পর্যন্ত জ্বলে উঠতে পারেননি, তাই মন খারাপ মুশফিকুর রহিমের। ছবি: প্রথম আলো
>

নিউজিল্যান্ড সফরে মুশফিকুর রহিম এখনো পর্যন্ত ভালো কিছু করতে পারেননি। দুই ম্যাচে ৫ আর ২৪ করার পর রীতিমতো আত্মদহনে তিনি। মুশফিক সব সময়ই নিজের পারফরম্যান্সের কঠোরতম সমালোচক

মুশফিকুর রহিমের মনটা খুব খারাপ। মুশফিককে যাঁরা চেনেন, তাঁদের কাছে অবশ্য এটা কোনো খবরই নয়। বরাবরই নিজেই নিজের পারফরম্যান্সের কঠোরতম সমালোচক। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে ৫ আর ২৪ রান করার পর মুশফিক যে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন, এতে আর আশ্চর্য কী!
মুশফিকের মনটা আরও বেশি খারাপ দুবার নতুন জীবন পেয়েও ২০০তম ওয়ানডেটা স্মরণীয় করে রাখতে না পারায়। মাশরাফির পর বাংলাদেশের মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ছুঁয়েছেন ২০০ ম্যাচের মাইলফলক। সেই ম্যাচে ভালো করতে না পারায় আত্মদহনে পুড়বেন, এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই-বা এমন ফলাও করে বলার কী আছে!
কারণটা বোঝাতে আবারও মুশফিককে চেনা না-চেনার প্রসঙ্গটা তুলতে হচ্ছে। মুশফিককে যাঁরা চেনেন, তাঁদের বোঝার কথা, ভালো করতে না পারার আত্মদহনটা এমন তীব্র হওয়ার পেছনে ২০০তম ম্যাচ অবশ্যই একটা কারণ। তবে মূল কারণ নয়। মূল কারণ অন্য এবং সেটিই মুশফিককে চিনিয়ে দেয় একজন আদ্যন্ত টিমম্যান হিসেবে, ‘২০০তম ওয়ানডেতে অবশ্যই ভালো কিছু করতে চেয়েছিলাম। তবে সেটি শুধু নিজের জন্য নয়। ম্যাচটা এমন ছিল যে দলের জন্যও ভালো করা খুব দরকার ছিল। ভাগ্য যেমন পক্ষে ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, হয়তো পারব। কিন্তু পারলাম না।’ মুশফিকের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশের পক্ষে শততম ওয়ানডেটা কবে, কোথায়, কার বিপক্ষে খেলেছিলেন, চেষ্টা করেও সেটি মনে করতে পারলেন না। অথচ সেটি খেলার সময় তিনিই বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। বাংলাদেশের ইনিংসে সর্বোচ্চ ৬৯ রানও তাঁরই ব্যাট থেকে। তারপরও তা মনে না করতে পারার কারণটাও হয়তো মুশফিককে চিনিয়ে দেয়। ২০১১ সালের ১৫ অক্টোবর মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই ম্যাচে যে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে হেরেছিল।
ক্রাইস্টচার্চে যে ২০০তম ম্যাচটা খেলতে নামছেন, এটা জানতেন। এটাকে বড় কিছু মনে করেন, আবার করেনও না। ধাঁধার উত্তরটা পেয়ে যাবেন মুশফিকের কথা থেকেই, ‘আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে দুই শ ম্যাচ খেলতে পারা সহজ নয়। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তা খেলতে পেরেছি বলে খুশি। তবে এই দুই শ ম্যাচে আমি এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছুই করতে পারিনি। এরপর যতগুলো ম্যাচই খেলি, চেষ্টা করব ভালো কিছু করতে।’
নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন এবং কিউই বোলারদের গতি আর সুইংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের একজন ব্যাটসম্যানের ওপর বাজি ধরতে বললে বেশির ভাগ মানুষ মুশফিকের নামটাই বলবেন। নিয়মকে প্রমাণ করা দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে তাঁর ঠান্ডা মাথা আর মোটামুটি নিশ্ছিদ্র টেকনিক মিলিয়ে পরিস্থিতি যত কঠিন, মুশফিকের কাছে আশা ততই বেশি। টেকনিক প্রসঙ্গটা তোলায় অবশ্য মুশফিক মজার একটা উত্তর দিলেন, ‘টেকনিক নিয়ে এত কথা বলার কিছু নেই। যে যাঁর মতো। স্টিভ ওয়াহ পুল শট না খেলেই কি টেস্টে দশ হাজার রান করেনি? সেটিও কী সব বোলারের বিপক্ষে খেলে! টেকনিক ভালো হলে অবশ্যই সেটি সাহায্য করে, তবে সেটিই রান পাওয়ার নিশ্চয়তা নয়।’
এই সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচেই ব্যর্থতার ব্যাখ্যা কী আছে তাঁর কাছে? নিউজিল্যান্ডের বোলারদের গতি ভোগাচ্ছে নাকি সুইং? মুশফিক দাবি করলেন, এর কোনোটাই নয়, ‘গতি কোনো সমস্যা না, বিপিএলেও এমন গতির বোলার ছিল। এখানে পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে বাউন্সে। আমাদের দেশে বাউন্সার দিলে বল ব্যাটসম্যানের অনেক দূরে পড়ে। আর এখানে গুড লেংথের বলও এমনভাবে লাফিয়ে ওঠে যে মনে হয় ওভারের ছয়টা বলই বাউন্সার!’
তারপরও নিউজিল্যান্ডের নির্দিষ্ট কোনো বোলার বা কোনো বোলারের নির্দিষ্ট কোনো বল কি সমস্যায় ফেলছে? মুশফিক এবার উত্তরটা দিলেন মুখে হাসি ফুটিয়ে, ‘না, কোনো বোলার বা কোনো বলেই আমার সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যাটা করছে আমার ব্যাটের কানা। আশা করি, এরপর বল আর ব্যাটের কানায় লাগবে না, লাগলেও চার হয়ে যাবে।’
তা ‘ব্যাটের কানা’ একটা সমস্যাই বটে। প্রথম দুই ম্যাচেই একইভাবে আউট হয়েছেন মুশফিক। ব্যাটের কানায় লাগিয়ে বল টেনে এনেছেন স্টাম্পে। তৃতীয় ম্যাচে সেটির পুনরাবৃত্তি তো ঠেকাতেই চান, করতে চান বড় কিছুও। প্রথম দুই ম্যাচে ব্যর্থতার বড় কারণ মনে করেন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ‘বিগ থ্রি’র ব্যর্থতাকে। শেষ ম্যাচে ভালো করার পূর্বশর্তটাও তাই তাঁর জানা, ‘তামিম, রিয়াদ ভাই অথবা আমি-আমাদের তিনজনের কাউকে বড় রান করতেই হবে।’
নেপিয়ার আর ক্রাইস্টচার্চ যে দুঃস্বপ্ন উপহার দিয়েছে, তাতে সফরটা অনেক লম্বা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুরুতেই যে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসার কথা বললেন, সেটিই মুশফিককে এমন মনে করতে দিচ্ছে না, ‘এমন তো আগেও হয়েছে। আমরা আবার ফিরেও এসেছি। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বশেষ সফর ছাড়া আর কোথায় আমরা এত বাজে শুরু করেছি, মনে করতে পারছি না।’ কেন, গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে শুরুতেই টেস্ট সিরিজের কথা ভুলে গেলেন নাকি? ‘হ্যাঁ, ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজে আমরা খারাপ করেছিলাম’ বলার মুশফিকের মুখে আবারও হাসি, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা বলছেন? কেন, র্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বর টিম ইংল্যান্ড ওখানে গিয়ে কী করেছে, দেখেননি?’
প্রথম দুই ম্যাচে নিজের পারফরম্যান্সে মন খারাপ, দলের পারফরম্যান্সে আরও বেশি। তবে মুশফিকের সবচেয়ে বড় মন খারাপের কারণটা সিরিজ শুরুর আগেই। নিজের প্রস্তুতি নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে। মাঠে নামার পর কী হবে, সেটি তো আর নিজের হাতে নেই। কিন্তু যেটি নিজের হাতে, সেই প্রস্তুতিতে কখনোই কোনো খুঁত রাখতে চান না। অথচ এবার সেটিই হয়েছে। বিপিএল থেকে তাঁর দলের আগেই বিদায় নেওয়াটা ‘শাপে বর’ই হয়েছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি দলের প্রথম অংশের সঙ্গেই চলে আসতে পেরেছিলেন নিউজিল্যান্ডে। কিন্তু এসে কোনো লাভ হয়নি। পরের দুই দিনই ছিল শনি আর রোববার। উইকএন্ডে তারা নিজেরাই খেলে বলে নেট বোলার দিতে পারেনি স্থানীয় আয়োজকেরা। মুশফিকের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পেসার বলতে এক মোস্তাফিজ। টানা ম্যাচ খেলার পর তাঁরও বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। মুশফিক তাই নেটে ব্যাটিং করেছেন মিরাজ-নাঈম-সৌম্যর বোলিংয়ে। মুখে ব্যঙ্গের হাসি আর চোখে ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন ফুটিয়ে মুশফিক বললেন, ‘নেটে মিরাজ-নাঈমের বোলিং খেলে ম্যাচে বোল্ট-হেনরি-ফার্গুসনকে খেলার প্রস্তুতি! ক্রিকেট খেলাটা এত সোজা হলে তো হতোই!’