মাঠ এত সুন্দরও হয়!

এই সেই দৃষ্টিমোহন বার্ট সাটক্লিফ ওভাল। ছবি: অকল্যান্ড ক্রিকেট
এই সেই দৃষ্টিমোহন বার্ট সাটক্লিফ ওভাল। ছবি: অকল্যান্ড ক্রিকেট

ক্রাইস্টচার্চে এর আগে যে তিনবার উবারে চড়েছি, তিনবারই কাকতালীয় মিল। ড্রাইভার শিখ এবং ক্রিকেটের পাগল। আজ সকালে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ম্যাচ কাভার করতে বার্ট সার্টক্লিফ ওভাল মাঠে যাব বলে উবার ডাকার সময় মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছি, এবারও যেন তা–ই হয়। ক্রাইস্টচার্চ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে এই মাঠ। এর আগে কোনো দিন যাইনি এবং রাস্তাঘাট না চেনার ব্যাপারে আমার যে বিস্ময়কর প্রতিভা, তাতে ড্রাইভারও মাঠটা না চিনলে একটা ভজকট না হয়েই যায় না। বার্ট সাটক্লিফ ওভাল সম্পর্কে শুধু এটুকুই জানি, লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ওই মাঠ। এই জানাটাই কাল হলো। উবার অ্যাপে ‘গন্তব্য’ নির্বাচন করার সময় বার্ট সাটক্লিফ ওভাল দিলেই হতো, কিন্তু আমি দিয়ে ফেলেছি ‘লিঙ্কন ইউনিভার্সিটি’। আমার প্রার্থনা বিফল করে ড্রাইভারের যে নামটা মোবাইলে ভেসে উঠল, তাতেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, কপালে আজ একটা দুর্ঘট আছেই। বিদঘুটে একটা নাম—ফামাসিনোগা।

ইয়া পাহাড়প্রমাণ এক লোক। গাড়িতে উঠে আলাপ হলো। সামোয়া দ্বীপপুঞ্জ থেকে ২০ বছর আগে চলে এসেছেন নিউজিল্যান্ডে। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে পরিচয় দূরে থাক, সেটির নাম শুনে এমন একটা ভঙ্গি করলেন যেটির অর্থ—ক্রিকেট! এটি খায় না মাথায় দেয়! শহর থেকে বেরোতেই দুপাশে চোখজুড়ানো সব দৃশ্য। সবুজ ছড়িয়ে গেছে দিগন্ত পর্যন্ত। কোথাও ভেড়ার পাল চরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমার তখন সেসব উপভোগ করার মতো অবস্থা নয়। কারণ, গাড়ি মিনিট পনেরো চলার পরই ফামাসিনোগা জানিয়েছেন, এত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন। এই রাস্তায় তাঁর আজই প্রথম।

শেষ পর্যন্ত দুই–তিন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে, লোকজনকে জিজ্ঞেস করে কীভাবে বার্ট সাটক্লিফ ওভালে পৌঁছাতে পারলাম, সেটির বিস্তারিত বর্ণনা আর না দিই। গাড়ি থেকে নেমে মাঠটায় চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে এতক্ষণের উৎকণ্ঠা আর বিরক্তি ধুয়েমুছে একাকার। নিউজিল্যান্ডে আমার এটি পঞ্চম ট্যুর। এর আগের চারবার যা মনে হয়েছে, আবারও তা–ই মনে হলো, শুধু মাঠ দেখতেই এই দেশে আসা যায়। বার্ট সাটক্লিফের নামাঙ্কিত বলে এই মাঠটা নিয়ে আগে থেকেই বাড়তি একটা কৌতূহল ছিল। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম গ্রেট ব্যাটসম্যান তিনি।

ব্যাচেলর পার্টি করতে বেরিয়েছেন। ছবি: লেখক
ব্যাচেলর পার্টি করতে বেরিয়েছেন। ছবি: লেখক

সেই শুরুর দিকে ৪২ টেস্ট খেলে ৪০.১০ গড়ে ২৭২৭ রান যার সবটা বোঝাতে পারছে না। তবে একটা আক্ষেপ নিয়েই টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করতে হয়েছে তাঁকে। টেস্ট জয়ের স্বাদ ছাড়াই। মনে আছে, ২০০১ সালে এই দেশে বাংলাদেশের প্রথম সফরে টেস্ট সিরিজ শেষে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান পুরস্কার বিতরণীর বক্তৃতায় সাটক্লিফের এই দুর্ভাগ্যের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্য পেতে সময় লাগে। বাংলাদেশ যে নিউজিল্যান্ডের আগেই তা পাবে, বলে দিয়েছিলেন সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়ার কারণটাও, ‘বাংলাদেশকে নিউজিল্যান্ডের মতো টেস্টে প্রথম জয় পেতে ২৬ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। কারণ, নিউজিল্যান্ডের সমস্যা বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক। এত মানুষের দেশে ১১ জন ভালো ক্রিকেটার পাওয়া কঠিন কিছু নয়।’ তখন নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যা ছিল ৪২ লাখের মতো। এখন হয়তো একটু বেড়ে থাকবে।

বার্ট সাটক্লিফের নামটা আগেও জানতাম। তবে সেই বক্তৃতা শোনার পর থেকেই সেটি আরও মনে গেঁথে যায়। আগে নাম ছিল ‘বিল ওভাল’, সাটক্লিফের নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রথম শ্রেণির ম্যাচ হয় এখানে, ছেলেদের দুটি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচও হয়েছে (কেনিয়া–হল্যান্ড, স্কটল্যান্ড–আরব আমিরাত), তবে মূলত মেয়েদের আন্তর্জাতিক ম্যাচেরই ভেন্যু এটি। মেয়েদের ৫৮টি ওয়ানডে হয়েছে এখানে। মেয়েদের ২০০০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালও। যেটি আবার জিতেছে নিউজিল্যান্ড। এই মাঠের সবচেয়ে বড় ব্যবহার অবশ্য নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের একমাত্র একাডেমি হিসেবে। বছরে আট মাস এখানে রেখে তৈরি করা হয় ভবিষ্যতের ক্রিকেটারদের। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম এখান থেকেই বেরিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের বতর্মান দলের রস টেলর ও মার্টিন গাপটিলও এই একাডেমির ফসল। তুলনায় কম বিখ্যাত আরও কে কে যেন আছেন।
বার্ট সাটক্লিফ নিয়ে লেখার অনেক কিছু আছে। ১৯৫২–৫৩ মৌসুমে তাঁর ৩৮৫ রানের ইনিংস ব্রায়ান লারার আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কোনো বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর হয়ে ছিল। পরের মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে জোহানেসবার্গ টেস্টে বাউন্সার লেগে রক্তাক্ত কানের লতি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দলের অবস্থা খারাপ দেখে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় চলে আসেন মাঠে। দলের ১৮৭ রানের মধ্যে একাই করেন অপরাজিত ৮০। বাঁচান ফলোঅন। ক্রিকেটে বীরত্বের বড় উদাহরণ হয়ে আছে ওই ঘটনা। মাঠের মূল ভবনের গায়ে একটা নামফলক আছে। ভেতরে আছে সাটক্লিফের কিছু ছবি। একটা বড় বোর্ডে তাঁর অমর সব কীর্তির সারাৎসারও।

আমার মাঠটা দেখে মুগ্ধ হওয়ার কারণ তো আর এসব নয়। উপমহাদেশে ক্রিকেট স্টেডিয়াম বলতেই ‘কংক্রিটের জঙ্গল’, নিউজিল্যান্ডে বেশির ভাগ মাঠই তেমন নয়। এটি আরও বেশি সুন্দর, কারণ মূল প্যাভিলিয়ন ভবনটা ছাড়া মাঠের পাশে আর কোথাও গ্যালারি–ট্যালারি কিচ্ছু নেই। শুধু ঘাসের গালিচা এবং একটু দূরে দূরে সেখানে বসানো কিছু বেঞ্চ। প্যাভিলিয়নের উল্টো পাশে গাছের সারি। জিজ্ঞেস করে জানলাম, বড় বড় যে গাছগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো ‘গাম ট্রি’ মানে গাম আরকি! পাশেই মাথায় ঝাঁকড়া চুলের মতো ডাল–পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো উইলো। উইলো মানে যে গাছের কাঠ দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট তৈরি হয়? হ্যাঁ, সেই উইলোই! আগেও দেখেছি, তারপরও পুরো মাঠ ঘুরে আবারও কাছ থেকে সেটি দেখে এলাম। ছবিও তুললাম।

ঝাঁকড়া চুলের মতো ডাল–পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ গাছগুলো উইলো। ছবি: লেখক
ঝাঁকড়া চুলের মতো ডাল–পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ গাছগুলো উইলো। ছবি: লেখক

বাংলাদেশে সফরকারী যেকোনো টেস্ট দলের প্রস্তুতি ম্যাচ দেখতেও মোটামুটি কিছু দর্শক হয়। এখানে কখনো মোট দর্শকসংখ্যা চার-পাঁচজনও ছাড়াল কি না সন্দেহ! লাঞ্চের সময় হঠাৎ করেই অবশ্য সেটি চার–পাঁচ গুণ হয়ে গেল। নীরব–নিস্তরঙ্গ মাঠে শোনা গেল তুমুল হইচইও। ঘটনা কী? ১৫–১৬ জন তরুণের একটা দল প্যাভিলিয়ন ভবনের পাশে ফেন্সিংয়ের পাশে ভিড় করেছে। সবার গায়ে একই রকম টি–শার্ট। বুকে একটাই ছবি। এক তরুণ হাঁ করে বার্গারজাতীয় কিছু খাচ্ছেন। যাঁর ছবি, বিচিত্র পোশাকের জন্য তিনি আগেই নজর কেড়েছেন। পরনে কোমরের একটু নিচে নামা মেয়েদের স্কার্ট, পায়ে নেটের মতো কিছু একটা জড়ানো, হাতে একটা মিনিয়েচার ব্যাট। কৌতূহল থেকে কাছে গিয়ে যা জানলাম, তা হলো বিচিত্র পোশাক পরা ওই তরুণের নাম ক্যামেরন প্লাক। আগামীকাল তাঁর বিয়ে। এর আগে বন্ধুদের নিয়ে ব্যাচেলর পার্টি করতে বেরিয়েছেন।

সবার হাতে বিয়ারের বোতল দেখেই বোঝা গেল, সেই পার্টির মূল উপাদান কী। দেখে আমার হ্যাংওভার সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। বিয়ে করতে যাওয়ার বন্ধুদের নিয়ে ওই তরুণের মাঠে আসার একটা উদ্দেশ্য আছে। বিয়ে করতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ নানা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। এর প্রথমটি হলো ওই মিনিয়েচার ব্যাটে বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের দুজন করে ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ নিতে হবে। নিরাপত্তাকর্মীরা আটকে দিয়েছে বলেই অমন হইচই। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অনুরোধে সাহায্যে এগিয়ে এলেন কোচ স্টিভ রোডস। ব্যাটটা নিয়ে গিয়ে তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের অটোগ্রাফ এনে দিলেন তিনি। হইহই করতে করতে ওই তরুণের দল বেরিয়ে গেল। আবার নীরবতা চার পাশে। মাঠ থেকে ক্রিকেটারদের কিছু কথাবার্তা আর ব্যাটে বল লাগার মধুর আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নেই। এভাবে ক্রিকেট দেখার মজাই আলাদা।